হারুন সাহেব হাসতে পারছেন না। কী একটা কারণে তিনি গম্ভীর হয়ে আছেন। কেউ হাসলে বা হাসির কথা বললে তাঁর মুখে বিতৃষ্ণা, বিরক্তি ফুটে উঠছে। হাসি থামাতে কখনো কখনো জোরালো ইংরেজি শব্দ শাটআপ, স্টুপিড ব্যবহার করছেন। রিনা বেগম স্বামীর এই না হাসা রোগ প্রথম আবিষ্কার করেন। ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে শম্পার কাছে রোগ প্রকাশ করতে গিয়ে ফিসফাস করে বলেন, এই শম্পা।
—হু।
—তোর বাবার না হাসা রোগ হয়েছে। আমি গত এক মাসের বেশি তাকে হাসতে দেখিনি।
বাবার হয়েছে না হাসা রোগ আর শম্পা মেয়েটার হয়েছে হাসি রোগ। কারণে–অকারণে একটু পরপর ক্যাকক্যাক করে হেসে উঠবে। মায়ের গুরুত্বপূর্ণ কথা শুনে সে খ্যাকক্যাক করে হেসে ওঠে।
—তুই হাসছিস!
—হু।
—তোর বাবার জন্য এতটুকু ভালোবাসা নেই? বেচারা হাসে না। মুখ গম্ভীর করে দিনরাত বসে থাকে।
—কিছু হাসি কিনলেই তো পারো।
—হাসি কেনা যায়!
শম্পা কিছুক্ষণ হেসে বলে, তোমার ভবঘুরে ভাগনে লিটনকে ফোন দিয়ে দেখতে পারো। আমার মনে হয় সে হাসি বিক্রি করতে পারে।
শম্পার কথায় রিনা বেগম কিছুটা খুশি হন বলে মনে হয়। মোবাইল ফোন এনে লিটনকে ফোন করেন, হ্যালো লিটন।
—হু।
—তুই কি হাসি বিক্রি করিস?
—কী বলছ খালা? হাসি বিক্রি! ঠিক বুঝলাম না।
—মানে তোর খালু দীর্ঘদিন হাসেন না। মুখ গম্ভীর করে বসে থাকেন। হাসি তাঁর সহ্য হয় না। কাউকে হাসতে দেখলে রেগে যান। চিৎকার করেন।
—ঠিক হয়ে যাবে।
—সত্যি!
—আমি কাল পরশু আসছি। ওনার না হাসা রোগ ভালো করে দেব। তুমি একদম চিন্তা করো না।
শম্পা খ্যাকখ্যাক করে হাসে।
কথার ভেতর হারুন সাহেব উপস্থিত। গম্ভীর গলায় বলেন, এই ক্যাকক্যাক করে মুরগির মতো হাসে কে!
শম্পা হারুন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা মুরগি কি হাসতে পারে?
হারুন সাহেব রেগে ওঠেন। চোখ দুটো লাল হয়। দরাজ গলায় বলেন, আমি হাসি দেখতে পারি না। হাসির শব্দ সহ্য করতে পারি না। আমার বাড়িতে একদম হাসাহাসি চলবে না।
হারুন সাহেবের ধমক আর লাল চোখে নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সারা দিনের হিসাব করে লিটন। এক. পত্রিকা অফিসে গিয়ে একটা বিজ্ঞাপন দিতে হবে। দুই. হাতখরচ বাবদ কিছু টাকা না হলে চলবে না। আপাতত নাসিম সাহেব ভরসা।
তিন. মেসের বকেয়া তিন মাসের ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে হবে। সেটা নির্ভর করছে হারুন সাহেবের হাসির ওপর।
একটা ছোট কাগজে লেখা শুরু করে, প্রিয় ভাই সব–বোন সব। আমার নাম হারুন। আমি একজন না হাসা রোগী। হাসতে পারি না। হাসি দিবসে কিছু হাসি কি বিক্রয় হবে? আমি হাসি কিনতে চাই। বিনীত, অভাগা না হাসা হারুন। মোবাইল নাম্বার...।
কাগজ পকেটে পুরে বের হতেই নাসিম সাহেবের সঙ্গে দেখা। তার প্রেমিকা জেমির সঙ্গে সম্পর্ক ছুটে গেছে বলে বিষণ্ন।
লিটন মুচকি হাসে। বিভ্রান্তির হাসি। ‘আজ ফোন করবে।’
—কে?
—জেমি। দাঁত কেলিয়ে আপনাকে হাসি দিবসের শুভেচ্ছা জানাবে।
নাসিমের মুখটা উজ্জ্বল হয়। সে হয়তো লিটনের কথা বিশ্বাস করেছে। জেমি ফোন না করুক মানুষটা যে একটু খুশি হলো এটাই–বা কম কী।
—শ পাঁচেক টাকা হবে ভাই?
নাসিম সাহেব দেরি করেন না। পকেট থেকে পাঁচ শ টাকার একটা নোট গুঁজে দেন। টাকা না দিলে যেন জেমি ফোন করবে না এমন একটা ভাব।
টাকা নিয়ে লিটন বেরিয়ে পড়ে। পত্রিকা অফিসে লিখিত কাগজ বিজ্ঞপ্তি হিসাবে প্রকাশের জন্য মিরপুরের দিকে যাত্রা। রিনা খালার বাসায় যেতে হবে। হারুন সাহেবকে হাসানোর মহান দায়িত্ব পড়েছে তার ঘাড়ে। হঠাৎ রিকশা দাঁড়িয়ে যায়। ঢাকা শহরে এই একটা বিপদ। কিছু দূর যেতে না যেতেই থমকে দাঁড়াবে গাড়ি। জ্যাম। বড় বিরক্তিকর হলেও বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। আশপাশে বাস গাড়ির প্যাপু শব্দে কান ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। হঠাৎ খট শব্দে বাসের জানালা থেকে মুখ বের করে উনিশ–কুড়ি বছরের তরুণী। ফর্সা মায়াবী চেহারা। বড় বড় চোখ। লিটন হা করে কিছুটা ওপরে বাসের জানালার দিকে তাকিয়ে। আহা কী সুন্দরী মে...। ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই হড়বড় করে বমি। সবটুকু লিটনের মাথা–মুখে। একবার–দুইবার। লিটন চিৎকার করে, দোহাই লাগে...। তৃতীয়বারের কিছু তীব্র গন্ধযুক্ত তরল পদার্থ মুখের ভেতর চলে যায়। ঢোঁক গেলা যাবে না। পানি দরকার। সেই থেকে ২০ মিনিট হোপ মেরে বসে আছে। বমি গোসল হয়ে বসে থাকা। রিকশা ড্রাইভার বেজায় খুশি। একজন মানুষের গা ভরে উৎকট গন্ধের বমি ঢেলে দিলে যেন বিরাট খুশি হতে হয়। চিড়িয়াখানায় একজন শিশু যেভাবে কৌতূহল নিয়ে বাঘ, সিংহ দেখে একটু পরপর, সেভাবে লিটনের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাচ্ছে। লিটনের রাগ হলেও কিছু বলতে পারছে না।
—ভাইসাব খুব গন্ধ বেরোচ্ছে। কড়া বমি। মানুষের মাথায় ঢালতে হলে এ রকম বিষ মার্কা বমিই ঢালা উচিত।
লিটন হোপ মেরে আছে। কথা শুনে বেচারা ড্রাইভারকে লাথি মেরে ড্রেনের ভেতর ফেলে দিতে ইচ্ছা করে। এই মুহূর্তে সে কাজটাও করা যাবে না। দ্রুত রিনা খালার বাসায় পৌঁছাতে হবে।
রিনা খালার বাসায় পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডোরবেল চাপতেই দরজা খুলে যায়। রিনা বেগম। লিটনকে দেখে চমকে ওঠেন। নাক চেপে বলেন, তোর এই অবস্থা কেন! সেফটিক ট্যাংকিতে ডুব দিয়ে এসেছিস নাকি!
—আর বলো না, বাসের জানালা দিয়ে এক মেয়ে আমার গায়ে হড়বড় করে ঢেলে দিল।
রিনা বেগম বলেন, তাড়াতাড়ি বাথরুমে যা। সাবান, শ্যাম্পু সব আছে। পুরো এক ঘণ্টা গোসল করবি।
লিটন প্রবেশ করার পর থেকেই হারুন সাহেবের মেজাজ খারাপ। বদমাশটা বাড়িতে আস্তানা গেড়ে বসেছে। ভাবখানা এমন সে যেন এ বাড়ির বড় কর্তা। একটা জোচ্চর ছেলে বাড়িতে ঢুকে হুলুস্থুল করছে। তার সঙ্গে স্ত্রী রিনা, মেয়ে শম্পা একনাগাড়ে খ্যাকখ্যাক করে হাসছে। সহ্য করতে না পেরে হারুন সাহেব ধেয়ে আসেন। এই কী হচ্ছে বাড়িতে? এইটা কী ক্লাব নাকি?
লিটন মুচকি হাসে। কিছু হাসি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। কেউ কড়া গলায় ধমক দিলে বিচলিত না হয়ে খুব স্বাভাবিকভাবে মুচকি হাসি দেওয়া কঠিন। ধমকানো লোক ঘোরের ভেতর পড়ে যান। অবশ্য হারুন সাহেবের বেলায় সেটা ঘটল না। তিনি আরও রাগ বাড়িয়ে বলেন, এই জোচ্চর হাসছিস কেন? আমি হাসি দেখতে পারি না। হাসির শব্দ সহ্য করতে পারি না। একদম হাসবি না।
—এটা তো একটা রোগ। আমি তো আপনার চিকিৎসার জন্য এসেছি।
—এই ছাগল তুই কি ডাক্তার নাকি?
—রিনা খালা আসেন ওনাকে ধরে কাতুকুতু দিই। কাতুকুতু দিলে স্নায়ু উদ্দীপিত হবে এবং মস্তিষ্ক সচল হওয়ার ফলেই তিনি হাসবেন। সাধারণত শরীরের যে অংশগুলোতে হাড় থাকে না, সেই অংশগুলোতে কাতুকুতুর অনুভূতি বেশি হয়। যেমন পেটের পাশে বা নিচে অথবা পায়ের পাতার নিচে। ছয়টা হাতে ওনাকে ২০ মিনিট একভাবে কাতুকুতু থেরাপি দেওয়া হবে। লিটন শুরু করতেই রিনা বাঘের মতো হামলে পড়ে। তারপর সম্পা।
অল্প সময়। হারুন সাহেব খিলখিল করে হাসতে শুরু করেন। ২০ মিনিট পর হারুন সাহেবকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েন। লিটন বলে, খালা হাসা যখন শুরু করেছে আর থামবে বলে মনে হয় না।
সন্ধ্যা নামতেই হারুন সাহেবের মুঠোফোনে একের পর এক ফোন আসতে শুরু করে। রিসিভ করলেই ও প্রান্তে হাসির শব্দ। হাসি দিবসের শুভেচ্ছা। হাসি ক্রয় করবেন? আমার হাসিটা ভালো না? হাসি বিক্রয় হবে। সবার প্রায় একই কথা। কথা শেষ করতে না করতে আবার ফোন। হারুন সাহেব কিছু বুঝে উঠতে পারেন না।
‘হাসি দিবসের শুভেচ্ছা।’ মায়াবী মিষ্টি গলার এক মেয়ে। হারুন সাহেব ভারী গলায় বলেন, কিসের হাসি দিবস! তোমাকে তো চিনতে পারলাম না।
—আমাকে তো চেনার কথা না। আমি হাসি বিক্রয় করব।
—বি ক্রয় না করে এ ক্রয় করা যায় না?
—আপনি কিনবেন না?
—না কিনা উপায় আছে! জোর যার মুল্লুক তার। মুল্লুকটা দিন দিন ভাল্লুক হতে চলেছে।
কথা শেষ করে হারুন সাহেব হাসতে হাসতে নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। হাসিমুখে ডাকেন, রিনা, শম্পা।
লিটন, রিনা, শম্পা তিনজন পাশের রুমে গল্প করছিল। রিনা স্বামীর হাসিমুখ দেখে অবাক হয়। মায়া নিয়ে বলে, কী হয়েছে গো?
—একের পর এক ফোন আসছে। লাইন দিয়ে মানুষ হাসি দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। সবাই হাসি বিক্রি করতে চায়। এই আজ কি হাসি দিবস নাকি? হাসি দিবসে সবাই হাসি বিক্রয় করতে চাচ্ছে কেন রে? কথা শেষ করেই গাল ভরে হো হো করে হেসে ওঠেন।