স্বগতোক্তি: আহাদ আদনান
পিপিই খুলে ফেলে দেওয়ার কক্ষ। আমরা বলি ‘ডফিং রুম’। দস্তানাটা ঝুড়িতে ফেলার পর লম্বা একটা শ্বাস ছাড়লাম।
‘ভাইয়া, একটু আসবেন?’
দরজার বাইরে রাহাতের গলা। পিপিই পরা। মুখোশ আর গগলসের জন্য মুখ আর চোখের অভিব্যক্তি বোঝা যায় না। কণ্ঠে উদ্বেগ আর অসহায়ত্ব প্রকট হয়ে আছে।
‘কী হয়েছে?’
‘মনিটরে খারাপ কিছু দেখাচ্ছে। স্যাচুরেশনের একই অবস্থা। আব্বু কি এক্সপায়ার করল?’
স্নাতকোত্তর পড়ছে নিজের খরচায়। কোনো বেতন নেই। বেসরকারি ক্লিনিকে ডিউটি করতে হয় পেট চালাতে।
কী বলব বুঝতে পারছি না। রাহাত আমার মেডিকেল কলেজের ছোট ভাই। গ্রাম থেকে উঠে আসা ছেলে। বাবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এমবিবিএস পাস করেছে পাঁচ বছর হয়ে গেল। নিয়মিত কোনো চাকরি নেই এখনো। স্নাতকোত্তর পড়ছে নিজের খরচায়। কোনো বেতন নেই। বেসরকারি ক্লিনিকে ডিউটি করতে হয় পেট চালাতে। সারা রাত ডিউটি করলে দেড় হাজার টাকা করে দেয়। করোনা আসার পর সেই বেতন হয়ে গেছে অর্ধেক আর অনিয়মিত। এর মধ্যে ওর বাবার কোভিড পজিটিভ হয়ে হঠাৎ করেই অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কালই ভেন্টিলেটরে দিয়েছি। শ্বাসনালিতে যখন নল ঢোকাচ্ছি, বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল চিকিৎসক ছেলে। ওর মুখ আর চোখটা আমি দেখতে পারিনি।
রাহাতের কথায় আমি কী জবাব দেব বুঝতে পারছি না। পিপিই ছাড়া করোনা ইউনিটে ঢোকা মানে মৃত্যুকূপে ঝাঁপ দেওয়া।
‘ভেতরে আর কে কে আছে?’
‘দুজন ভাইয়া আছেন। বেড দশ অ্যাপনিয়াতে (শ্বাসবন্ধ) চলে গেছে। ওনারা এতক্ষণ সিপিআর (মুমূর্ষু রোগীকে বুকে চাপ দিয়ে শ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা) দিচ্ছিলেন। আব্বুর অবস্থা তো আমি জানি। ওনাদের আর বিরক্ত করিনি। একজন যদি বেঁচে যায়, সেই চেষ্টাই হোক। আমার খুব খালি খালি লাগছে। আব্বু মনে হয় আর নেই। আপনি যদি একটু ডেথ ডিক্লেয়ার করে দেন?’
কয়েক মুহূর্ত আমি জড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
‘তুমি নিজেই তো চিকিৎসক। তোমাকে আর কি ডিক্লেয়ার করব?’
‘১২ ঘণ্টা ধরে আমি না খেয়ে কাজ করে গিয়েছি। আমার মাথাটা ঘুরছে ভনভন করে। পিপিই, মুখোশের জেলখানায় তীব্র গরমে আমি সেদ্ধ হয়ে গেছি। আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। কাজ করতে করতে আমার দুই হাত অসার। আঙুলগুলো কাঁপছে রীতিমতো। বাসায় নিজের মেয়েকে দেখি না দুই সপ্তাহ। মা অসুস্থ। দেখতে পারিনি এখনো।’
আমি চুপ করে থাকি। নিজের মনের ভেতর চলতে থাকে স্বগতোক্তির ঝড়। শুনতে পায় না রাহাত। জানতে পায় না এই সমাজের কেউ, এই দেশের কেউ।
আমার বিবেক আমাকে বলতে দেয় না, ‘তুমি নিজেই তো চিকিৎসক। তোমাকে আর কি ডিক্লেয়ার করব?’
নতুন একটা পিপিই পরতে থাকি। মুখ ঢেকে দিই মুখোশে। চোখ ঢেকে দিই গগলসে। হাত খাবলে ধরে একজোড়া দস্তানা।
নিজেকে মনে হয় খুব কঠিন এক যুদ্ধের একা, অসহায় আর নির্বাক এক যোদ্ধা।