সিনথিয়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাত এগারোটা ত্রিশ মিনিট। ফোনের চার্জ প্রায় শূন্যের কোঠায়। চার্জে লাগিয়ে সিনথিয়া বিছানায় ধড়াম করে শুয়ে পড়ল। ‘সিনথিয়া’ নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় মোটামুটি একনামে পরিচিত শারমিন মাহমুদ। স্বরচিত নাম। নিজেকে সে এই নামেই চিনতে ও চেনাতে পছন্দ করে। পশ-পশ লাগে।

বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই চোখের পর্দায় বিভিন্ন রঙিন মোবাইল অ্যাপের ছবি ভেসে উঠল। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, স্নাপচ্যাট, ইউটিউব, টিকটক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, অনলাইন শপিং অ্যাপ, মুভি ও সিরিজ ডাউনলোডিং অ্যাপ-লিংকসহ বেশ কয়েক রকম ছবি-ভিডিও এডিটিং অ্যাপ, পাবজির সঙ্গে আরও কতক প্লে স্টোরে অ্যাড হওয়ার নতুন নতুন গেমের অ্যাপ যেন কুচকাওয়াজ করতে করতে ডান পাশ থেকে বাঁ পাশে, বাঁ পাশ থেকে ডান পাশে পেন্ডুলামের মতো দুলছে। সিনথিয়ার চোখ জ্বালা করছে। চোখের নার্ভ বোধ হয় শুকিয়ে যাচ্ছে। একটু উঠে দুফোঁটা আর-টিয়ারসে দুচোখ ভিজিয়ে নিল।

তার রুমে ফেইরি লাইট জ্বলছে। নিজের নিশ্বাসের শব্দ আর অর্ধমৃত ফোনের টুং টুং শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে। সিনথিয়ার মন পড়ে আছে ফ্রেন্ডসদের সঙ্গে হ্যাং আউটে সাড়ে তিন শতাধিক ছবির মধ্যে নিজের সিঙ্গেল দেড় শ পোর্ট্রেটে। রিসেন্ট অনলাইন থেকে নেওয়া ফ্যানসি ড্রেসটা দারুণ স্যুট করেছে।

এদিকে রায়হান, যাকে সে গত ছয় মাস ধরে চেনে, সে অনবরত অখাদ্য-কুখাদ্য খুদে বার্তা পাঠাচ্ছেই তো পাঠাচ্ছে। ওই সমস্ত অ্যাপের মেসেজ সেকশনে। সিনথিয়ার মস্তিষ্ক তাড়া দিচ্ছে। এবার না উঠলেই নয়। চার্জ সেকশন এক শর মধ্যে শুধু তিনে উঠেছে। আরও কত বাকি! ফোনটা বুঝি মানুষ হলে কেঁদেই দিত। বলত, ‘পায়ে পড়ি, মশাই! ও থুক্কু! সম্রাজ্ঞী মহাশয়া, এবারের মতো প্রাণে বাঁচতে দিন!’ সিনথিয়ার এত দয়ামায়া নেই। থাকলে কি আর মায়ের কাছ থেকে বাবার অসুস্থতার কথা শুনেও, ‘তো আমি কি করব?’, বলে ধুম করে দরজা লাগিয়ে সময় কাটাতে পারত? তিন পার্সেন্ট মানে এখন সোনার খনি। সব অ্যাপে ঢুঁ মেরে এল। যে দীর্ঘশ্বাসের সাথে রায়হানসহ গুনে গুনে ছয় মাস পার করেছে সে, যে ছয় মাসে তোলা দুই সহস্রাধিক ছবির মধ্যে সেরা তিরিশ বাছাই করে সব অ্যাপে লোভনীয় ক্যাপশন দিয়ে আপলোড করতে যে শ্রম হয়েছে, তার অনেকটাই যেন উঠে এসেছে। এত শেয়ার, এত লাইক! আনন্দে খুশিতে রায়হানের কুখাদ্যের ডাবল কুখাদ্য রিপ্লাই পাঠিয়ে দিল।

ধ্যাত! আজকেই গেমে সিনথিয়ার সেগমেন্ট ছিল। ভুলেই গেছে একদম। এখন কি হবে? একটা স্টার নির্ঘাত খসে যাবে। কিন্তু মাথা ভার হয়ে আছে, সায় দিচ্ছে না একেবারে। থাক, হালকা মাথাব্যথার জন্য ফ্যানবেইজ লুজ করার মানে হয় না। তা ছাড়া খেলতে খেলতে স্ক্রিন রের্কড করে নতুন প্রোমো আকারে ইউটিউবে আপ দিলে এক সপ্তাহ নিশ্চিন্ত থাকা যাবে।

তথাস্তু! যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ।

চার্জে লাগিয়ে ফোন আয়তাকার ভঙ্গিতে ধরে খুব মনোযোগ দিয়ে গেম ওপেন করেছে সে।

বারোটা বিশ তখন ঘড়িতে।

দুম দুম রুমের বন্ধ দরজায় কিল পড়ল। বাবা হবে নিশ্চয়ই। অহেতুক পড়াশোনা নিয়ে জ্ঞান ছাড়বে। চুলোয় যাক ভদ্রলোক!

না হয় মা ভাত খাওয়ানোর জন্য ঘ্যান ঘ্যান করবে। সারা দিনে খাওয়া পেছনে নিয়ে ছোটা যেন মহিলার মুদ্রাদোষ। খুব বিরক্ত হলো সিনথিয়া। তবু জেদ ধরেছে তার। খুলবে না দরজা কোনোভাবেই।

চার্জে লাগানো অবস্থায় গেম শেষ করে, সব ধরনের ফোন অ্যাপ কর্মকাণ্ড অন্ত করে সাড়ে তিনটায় ঘুমিয়ে উঠতে উঠতে তার প্রায় বেলা এগারোটার মতো হলো। মনটা ভেতরে ভেতরে খুব খুশি। ফোন চার্জে লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। উঠে আবার আধা ঘণ্টা ফোনে চোখ দিয়ে রাখল। তীব্র ক্ষুধায় মাথা ধরে আছে। রাতে খাওয়া হয়নি। একটু ফ্রেশ হয়ে আউলানো চুল নিয়ে বের হতেই দেখে ডাইনিং রুম থেকে শুরু করে প্রতি রুমেই অনেক অনেক মানুষ। এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল বলেই এত মানুষের কথার শব্দ, গুন গুন কান্না বা কোরআন তেলাওয়াত—কিছুই সে শুনতে পায়নি।

ছোট মামি অনেকটা দৌড়ে এসে সিনথিয়ার মাথা একটা বড় ওড়নায় ঢেকে দিলেন। একই সাথে বললেন, ‘শারমিন, যা অজু করে আয়।’ সিনথিয়ার মাথায় যেন বাজ পড়ল! গতকাল রাতেও তো সব ঠিক ছিল। খুব অহমিকায় বাবা-মাকে পাত্তা না দিয়ে তার দিন তো খুব ভালোই কাটছিল। সাজানো সোফার রুম, দামি আলমারির রুম সব কালকের মতোই। শুধু রাশি রাশি মানুষের ঢল আজ। ছোট মামির উপদেশ মনে রইল না সিনথিয়ার। সে সবে শারমিনের রোল প্লে করতে চলেছে।

চুপচাপ পায়ে পায়ে মা-বাবার রুমের দিকে এগোতে লাগল। এক পা, এক পা সামনে দিতেই ফ্লোরে রাখা সাদা কোলবালিশ চোখে এল। সিনথিয়া এবার ভাবছে, হয়তো সবটাই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। আরেকটু কাছে আসতেই নাকের ফুটোয় তুলো গুঁজে থাকা ‘বাবা’ নামের মানুষটার চেহারা দেখে তার কানে বাজতে থাকে, ‘পড়ালেখাটা ঠিকভাবে কর, মা। এটা ছাড়া হোঁচট খাবি। পৃথিবী এত সহজ না, শারমিন।’ সিনথিয়ার হাঁটু তার পাপী মনের ভার বোধ হয় আর সইতে পারল না। শারমিন হয়ে দুপ করে বসে পড়ল। ভেউ ভেউ কান্নাতে শারমিন তখন হিমশিম খাচ্ছে। শারমিনের মা স্তব্ধ দৃষ্টিতে খোলা জানালা দিয়ে জীবনের এক ব্ল্যাকহোলের দিকে যাত্রার প্রারম্ভের সূচি লিখছেন। শারমিনকে কাঁদতে দেখে একবার তাকিয়ে আবার জানালায় মুখ ঘুরালেন, যেন সেদিকে তাকানোটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শারমিন ওরফে সিনথিয়া যেভাবে দিনের পর দিন প্রত্যাখ্যান করেছে বাবা মায়ের ডাক, বিধাতা বোধ হয় তাকে শাস্তি একটু কমই দিলেন। নতুবা কখন সে ঘুম থেকে উঠবে, বাবাকে শেষ দেখা দেখবে, এরপর জানাজা, দাফন করানো হবে—এত সব ভাবা হতো না কখনো।

শারমিনের বড় ভাই গতকাল খবর পেয়েই উড়ে এসেছে চাকরিস্থল থেকে। ভাইয়ের সাথেও অযাচিত আচরণ কম করেনি সে। ভাই তো ভাই, বাবা-মা নয়। মা-বাবা তো কখনো পারেনি শারমিনকে মন থেকে আনইনস্টল করতে।

চাইলে দরজার লক ভেঙে সিনথিয়াকে বের করে আনা যেত। তবে আসলেই কি লাভ হতো তাতে? ফোনের ন্যূনতম চার্জ, যে চার্জ ফোনকে বাঁচিয়ে রাখে, সে চার্জ রেখারও নিচে যার বিবেকের কোঠা তার কিবা উপলব্ধি হতো? খুব কান্নার ভান করে দু–চারটে পোস্ট দিত, হাওয়ায় ভাসা জগৎ থেকে সমবেদনা উড়ে উড়ে আসত। তবু ছুঁতে পারত না তাকে।

মাথা এখন পুরোপুরি খালি শারমিনের। নিজেকে খুব হালকা লাগছে। হিলিয়ামে ভরা বেলুনের মতো মনে হচ্ছে। আজকের দিনটা হয়তো ভেতর থেকে কিছু অপাচ্য বর্জ্য ডাস্টবিনে ছুড়ে দিয়েছে।

জোহরের আজান শোনা যাচ্ছে। জানাজায় নিয়ে যাওয়ার তাড়া শুরু হয়ে গেল। অজু করে শেষ কিছুক্ষণের জন্য বাবার পাশে বসে দোয়া-দরুদ পড়তে চেষ্টা করল সে। আমতা আমতা করতে লাগল মনে মনে। মনে পড়ছে না কিছুতেই। নিজের ব্যর্থতায় নিজের খুব কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই। বাবা তাঁর জীবন-ব্যাটারির সমস্ত সঞ্চিত শক্তি ছেলে-মেয়ের পেছনে লাগিয়ে আজ হার্টের চার্জ শূন্য করে চলে গেছেন। মায়ের ব্যাটারিতে চার্জ খুব বেশি বাকি নেই। ফুরোতে সময় নেবে না।

কিন্তু যার জীবনের চার্জ এখনো শতর কাছাকাছি, অহেতুকি কারবারে ব্যঞ্জন রেঁধে তিলে তিলে চার্জের হার নামানোর কোন মানে আছে?

ইউনিভার্সে একই সাথে একই রকম মানুষ সাতজন বাস করে, খায়, ঘুমায়, বাসা বাঁধে।

সাই-ফাই কল্পকথার সূত্রে গুন টেনে, ধরে নিই, শারমিনের ক্ষেত্রে ‘ইহা দ্বিতীয়া সত্যং’, অর্থাৎ তার জন্য জগতের সংখ্যা দুই। এক জগতে সে বাবার কবর হওয়ার পর দুই দিন শারমিন থাকবে। এরপর মানসিক যাতনা সইতে না পেরে আবারও পূর্বের সূত্রে ডাবল গুন টেনে সে মাস্কিট্রন লাগাবে।

এটি সেই ইলেকট্রনিক যন্ত্র, যা মস্তিষ্কে যুক্ত করলে দুঃখ–কষ্ট দূর করতে লেভেল বাড়ানো–কমানো যায়। সিলিন্ডার বিস্ফোরণে গায়ে আগুন লেগে মেয়ে মারা গেলে ডোপামিনের লেভেল বাড়িয়ে মা-বাবা সেই রাতে পার্টি করতে পারে। শারমিনও এক অদৃশ্য মাস্কিট্রন লাগাবে। সর্বোচ্চ পাওয়ার সেট করতে করতে সিনথিয়া হয়ে উঠবে।

আরেক ভিন্ন জগতে একই শারমিনের মনকে কুরে কুরে খাবে হতাশা, দুঃখ, দুর্দশা। নিজের ভুলের লম্বা লিস্ট বানাবে। একটা একটা ভুল সংশোধন করবে আর ভুলগুলোকে লাল কালিতে ক্রস দিতে থাকবে। নিজেকে নতুন এক শারমিনে পরিণত করবে, যে শারমিন কখনো কোনো কালে সিনথিয়া ছিল না—এ ব্যাপারেই বরং সবাই নিঃসন্দেহ হবে, পনেরো বছর পর নিজেকে এমন এক সংগঠনের সাথে চলতে দেখবে, যারা কাজই করে ‘সিনথিয়া’দের ‘শারমিন’ বানাতে।

ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়