সাফল্যের কথা বাবাকে বলতে চেয়েও পারেনি মম

তাপসী মমকে অভিনন্দন জানান বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি উত্তম রায়, নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌ ও সাধারণ সম্পাদক জাফর সাদিকছবি: শাকিব হাসান

মেয়েটা জন্মের পর থেকেই বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা করাতে পারেননি বাবা মো. সাজ্জাদ আল আমিন। এ ধরনের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। আর্থিক অভাব-অনটনের সংসারে যা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে আশাহত হননি তিনি। মেয়ের স্বপ্ন পূরণে সব রকমের চেষ্টাই করে যাচ্ছেন।

স্বপ্ন দেখেন, মেয়ে তাপসী মম একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে। কারও বোঝা হয়ে নয়, নিজের কর্ম দিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবে। ১৫ বছর বয়সী মম কথা বলতে পারে না, শুনতেও পায় না। তবে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটা কোনো বাধা নয়। এরই মধ্যে কম্পিউটার ব্যবহারে পারদর্শী হয়ে উঠেছেন।

সাজ্জাদ আল আমিন ও তাপসী মম
ছবি: ইমরান নাজীর

সম্প্রতি এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক, বাক্ ও শ্রবণ, দৃষ্টি এবং নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ও সিএসআইডি। সেখানে অংশ নিয়ে পুরস্কার অর্জন করেছে তাপসী মম। মেয়ের এমন সাফল্যে বাবা সাজ্জাদ আল আমিনের গর্বের যেন শেষ নেই।

চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় তপসী মম। স্কুলে খুব বেশি যাওয়া হয়নি তার। প্রতিবন্ধী হওয়ায় কোনো প্রতিষ্ঠান ভর্তি করাতে চায়নি। সেটা দেখে নিজেই একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন সাজ্জাদ আল আমিন, যা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম এমএসএফ আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেখান থেকে অন্য একটি স্কুলে রেজিস্ট্রেশন করনো হয়। সেখান থেকে পিইসি পাস করে মম। সাজ্জাদ জানালেন, ‘তখন এক ম্যাম বাসায় এসে পড়াতেন। তিনি নিজেও অফিস থেকে ১৯ দিনের ছুটি নিয়ে মেয়েকে সময় দেন। পিইসি পরীক্ষায় ৪.৮৩ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় মম।’ পাশের একটি স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি পাসের পর বর্তমানে বাসাতেই পড়াশোনা চলছে এই মেধাবী কিশোরীর। পাশাপাশি বাড্ডা লিংক রোডে অবস্থিত উদয়ন আইডিয়াল স্কুলে রেজিস্ট্রেশন করা রয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই কম্পিউটারের প্রতি ঝোঁক মমর। ওই সময় তাঁর বাবার একটা কম্পিউটার ছিল। সেটা দিয়ে মম নিজে নিজে কিছুটা শেখে। তা দেখেই মেয়েকে নিয়ে সাজ্জাদ আল আমিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তিনি জানালেন, ‘কিছুদিন আগে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন দেখি। দেখলাম মেয়ে কাজটা জানে, অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে ফেললাম। মাত্র ১০ দিন সময়ে তাকে যতটুকু সম্ভব প্রস্তুত করি।’ তবে মেয়েকে কাজ শেখানোর মতো কোনো কম্পিউটার নেই তাঁর। রেজিস্ট্রেশন তো করলেন, কিন্তু প্রস্তুত করাবেন কীভাবে সেটা নিয়ে বাড়ে চিন্তা।

সমাধানে এগিয়ে আসলেন সাজ্জাদ আল আমিনের পরিচিত এক বড় ভাই। তাঁর কাছ থেকে একটি ল্যাপটপ ধার আনেন। সেটি দিয়েই তাপসী মমকে প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করেন তাঁর বাবা।

বাক্ ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষেরা সাধারণত ইশারা ভাষা বোঝে। কিন্তু তাপসী মম এই ভাষা বোঝে না। বিভিন্ন জায়গায় ইশারা ভাষা শেখার কোর্স রয়েছে। অর্থের অভাবে মমকে শেখাতে পারেননি বাবা। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে সমস্যায়ও পড়তে হয়। যেমনটা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিযোগিতার পুরস্কার ঘোষণার মঞ্চে।

আয়োজকেরা যখন বিজয়ী হিসেবে তাপসী মমর নাম ঘোষণা করে, তখন সেটা বুঝতে পারেনি সে। বুঝবেই-বা কীভাবে, মম যে কথা বলতে ও শুনতে পায় না। পরে স্বেচ্ছাসেবী এসে যখন তাকে নিয়ে পুরস্কারের মঞ্চে নিয়ে গেলেন, তখনো সে কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। পুরস্কার হাতে পাওয়ার পরই বুঝতে পেরেছে নিজের অর্জন। সাজ্জাদ আল আমিন জানালেন, ‘মেয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। তখন আর কান্না ধরে রাখতে পারিনি আমি।’ বাবার এমন কান্নায় কষ্ট যেমন ছিল, গর্বও অনেক বেশি।

সব মেয়ের কাছে বাবা তাঁর সুপারহিরো। সাজ্জাদ আল আমিন ও তাপসী মমর গল্পটা যেন আমাদের সেটাই মনে করিয়ে দেয়।

তাপসী মমর এই সাফল্যে তাঁর বাসায় গিয়ে ফুল দিয়ে অভিবাদন জানান বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি, নির্বাহী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

লেখক, সাবেক সহসভাপতি, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা