সানির ভাবনা

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

মাত্র বাসায় ফিরেছেন রাইতুল ইসলাম। বাবা যতক্ষণ বাসায় থাকেন, ততক্ষণ সানির মুখে হাসি ফোটে। সারাক্ষণ বাবাকে সে চোখে চোখে রাখে। হাসতে হাসতে বাবার গালে-কপালে চুমু দেয়। আবার নিজের গাল-মুখ বাবার সামনে পেতে দেয়। চুমু খায়। ওর এমন আচরণে বাবা মনে মনে হাসেন। বাবাও ওকে কাছে পেলে জগতের সব কষ্ট ভুলে যান। একটু পরপর ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের শৈশবে হারিয়ে যান।
সানির বাবা রাইতুল ইসলাম পেশায় একজন শিক্ষক। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। সাংসারিক অভাব-অনটনে একটু-আধটু সহায়তা করার জন্য স্কুল-কলেজজীবন থেকেই টিউশনি করতে হয়েছে তাঁকে। ভার্সিটিজীবনে এ চাপ আরও প্রকট হয়েছিল। একসময় দিন–রাতের অধিকাংশ মুহূর্ত তিনি টিউশনির মধ্যে থেকেই কাটিয়েছেন। সংসারের চাকা সচল রাখতে আপ্রাণ খেটেছেন। শিক্ষার্থীদের জীবনের অঙ্কের হিসাব মেলাতে গিয়ে তিনি নিজের জীবনের অঙ্কে শতভাগ সফল হননি। অনার্সে কোনোমতে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করেছেন। একটি সরকারি চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা চালিয়েছিলেন। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে লিখিত পরীক্ষায় পার পেলেও কপাল দোষে তা হয়নি।

তারপর স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি নেওয়া। স্কুলে ইংরেজি পড়ান। সেই সুবাদে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর কাছে পড়ার জন্য ছেলেমেয়েরা লাইন ধরে। তিনি স্কুলের পর শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত সময় দিতে শুরু করেন। স্কুলের বেতন সামান্য হলেও প্রাইভেট-টিউশনির বেতন যোগ হয়ে ভালোই চলছিল তাঁর ছোট্ট সংসার। ছোট্ট সংসারের চাকা সচল রেখে গ্রামের বাড়িতে মা–বাবার জন্যও টাকা পাঠান তিনি।

হঠাৎ দেশে একটা মহামারি শুরু হলো। মানুষজন ঘরের বাইরে বের হতে ভয় পেতে শুরু করল। দেশ-বিদেশের অফিস–আদালতসহ সবকিছু বন্ধ হয়ে গেল। স্কুল–কলেজও বন্ধ। রাইতুল ইসলামের প্রাইভেট টিউশনিও বন্ধ। খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি। ইদানীং সারাক্ষণ বাসায় বসে বসে অলস সময় কাটান।

স্কুল থেকে জানানো হলো সব শিক্ষককে নিজ নিজ বিষয়ে সপ্তাহে ন্যূনতম দুটি করে ভিডিও ক্লাস করে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দিতে হবে। রাইতুল ইসলাম নিয়মিতভাবে ক্লাস তৈরি করে পাঠিয়ে দেন। এরই মধ্যে নির্দেশ আসে, যাঁদের বাসা প্রতিষ্ঠানের সন্নিকটে, তাঁদের প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে উপস্থিত হতে হবে। রাইতুল ইসলাম রোজ রোজ স্কুলে যান।

কিছুদিন পর স্কুল থেকে আবার নির্দেশ আসে, সব শিক্ষককে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খোঁজখবর নিতে হবে। রাইতুল ইসলাম নিয়মিতভাবে তা–ই করে চলেছেন। শুধু বেতনে সংসারের যাবতীয় খরচপাতি হচ্ছে না। এত দিন চাকরি ও প্রাইভেট টিউশনি করে মর্যাদার সঙ্গে চলেছেন। কারও কাছে ধারকর্জ করতে হয়নি। এখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। যে বেতন পান, তা দিয়ে কোনোমতে নিজেদের সংসার খরচ চলে। বাড়িতে কোনো টাকা পাঠাতে পারেন না। এ নিয়ে প্রায়ই আফসোসে পোড়েন তিনি। কিন্তু কী করবেন! মহামারির আতঙ্কও কমছে না। দিন দিন সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে।

সানির বয়স পাঁচ বছর পার হলো। বাবাকে একটু মন খারাপ করে থাকতে দেখলে ও যেন পাগলের মতো হয়ে যায়। বারবার বাবার গালে চুমু খায়। বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখে। আজও তা–ই করছে। রাইতুল ইসলাম সানির মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগলেন। তবু সানির মন ভরে না। সে অপলক দৃষ্টিতে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

পাশ থেকে সানির মা ইতি আক্তার স্বামীর উদ্দেশে বলে ওঠেন, কী হলো? তোমরা এমন করছ কেন?
রাইতুল ইসলাম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমার ছেলে আমার প্রাণ। আমার বাবার মতো। একটু মন খারাপ দেখলেই বুঝতে পারে আমাকে। এই তো আজ একটা বিষয়ে খুব টেনশনে আছি। বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সানি আমায় খেয়াল করতে শুরু করল। ভালো আছি বোঝাতে ওর সামনে ভানও করেছি। কিন্তু ও ঠিকই ধরে ফেলেছে। আমি সুখে নেই। ওর অবুঝ চোখের চাহনিকে কোনোভাবেই ফাঁকি দিতে পারছিলাম না, ইতি।
ইতি আক্তার চিন্তিত হয়ে বললেন, আবার কী নিয়ে টেনশন করছ!
আজ বেলা ১১টায় প্রিন্সিপাল স্যার সবাইকে নিয়ে মিটিং ডেকেছেন। আমার খুব ভয় করছে। এমনিতেই চলতে কষ্ট হচ্ছে। তার ওপর…।
মিটিং ডেকেছেন তো কী হয়েছে? স্যার হয়তো তোমাদের কোনো নির্দেশনা দিতে পারেন।
হ্যাঁ, এ বিষয়ে কয়েকজন কলিগের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাঁরা বললেন, এ মাস থেকে আমাদের বেতন শুধু বেসিক দেওয়া হবে। তুমিই বলো না, এমন হলে কেমন করে চলব?
শুধু শুধু চিন্তা কোরো না। নিশ্চয় একটা উপায় বের হবে।
ওটাই তো আমাদের শেষ ভরসা।

সানি এতক্ষণ মা–বাবার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
একটু পর রাইতুল ইসলাম ও ইতি আক্তার ব্যালকনির দিকে এগিয়ে আসেন। সানিকে নিয়ে তাঁরা গল্প শুরু করেন।
সকাল সাড়ে ১০টা বাজে। রাইতুল ইসলাম হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে বের হতে লাগলেন। এরপর ছেলের উদ্দেশে বললেন,
সানি, আমি যাচ্ছি, বাবা। আসার সময় তোমার জন্য চিপস নিয়ে আসব।
ঘরের ভেতর থেকে সানি জোর গলায় বলল, না বাবা, আমার চিপস লাগবে না। চিপস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়!

কবির কাঞ্চন: বেপজা পাবলিক স্কুল ও কলেজ চট্টগ্রাম, সিইপিজেড, ইপিজেড, চট্টগ্রাম।

বন্ধুসভায় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]