সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠা

প্রতীকী ফাইল ছবি
বন্ধুসভা

একালের শিশুদের যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, বড় হয়ে তোমরা কী হবে? উত্তর দেয় পুলিশ হব, মিষ্টিওয়ালা হব, বাদামওয়ালা হব ইত্যাদি। কেন তারা এসব পেশার প্রতি আগ্রহ দেখায়, তার যথাযথ উত্তর মনোবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই দিতে পারবেন। আমরা সাদা চোখে দেখি, শিশুরা বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শৈশবের লক্ষ্য থেকে সরে আসে। অভিভাবকেরা শিশুর তুষ্টির জন্য প্রথম দিকে তাদের ইচ্ছাগুলোকে সায় দেন বটে, কিন্তু যতই তারা বড় হয়ে উঠতে থাকে, অভিভাবকেরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধাচরণের পরিমাণ ততই বাড়িয়ে দিতে থাকেন। অভিভাবকদের সেই প্রচেষ্টার সূত্রে বড় হয়ে ওঠা শিশুরা বেড়ে ওঠে তথাকথিত মানুষ হয়ে। আর্থসামাজিক নিষ্পেষণের জন্য সভা-সমিতি আছে, জাতিসত্তা বিলুপ্তি কিংবা ভাষার মৃত্যুরোধে হাহাকার আছে, কিন্তু প্রতিভার নিষ্পেষণ বা অবদমনের প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের কি কোনো দায় নেই? যদি দৈহিক আঘাতের জন্য শিশুদের পাশে দাঁড়াই, তবে শিশুর শৈশবের আনন্দ কেড়ে নির্যাতিত করার জন্য তাদের পাশে দাঁড়াব না কেন?

একালের শিশুদের বড় করে তোলা হয় অর্থোপার্জনের যন্ত্র হিসেবে। এর সঙ্গে কোনো কোনো শিশু সংগীত, চিত্রকলা ইত্যাদির পাঠ নেয় বটে, কিন্তু মূল পাঠ হিসেবে নেয় না। জীবন বাঁচানোর জন্য শিল্প-কলকারখানার দিকে যতটা নজর দেওয়া হয়, জীবন সাজানোর জন্য শিল্পকলার দিকে ততটাই কম নজর দেওয়া হয়। দুইয়ের দরকার আছে। তবে তার অনুপাতটাও জানা দরকার। এই দরকার-অদরকারের দ্বন্দ্বের ভেতরে বড় হয়ে ওঠা মানুষেরা, বড় হয়ে অনেক বেশি অর্থোপার্জনের জন্য ঘুষের চাকরি নেবে কি না, অনৈতিকভাবে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে আসক্ত হবে কি না—এসব অমূল্য বা মূল্যহীন ভাবনা দুর্মূল্যের বাজারে পাত্তা পায় না। অর্থোপার্জনের যন্ত্র হিসেবে যে যতটা সার্থক, তার মানবজন্মও ততটাই সার্থক, তেমনটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এর ভেতর দিয়ে এসব অভিভাবক আবার নতুন প্রজন্মের কাছে সততা বা নৈতিকতার মতো ক্রমান্বয়ে দুর্লভ হয়ে ওঠা গুণগুলোরও প্রত্যাশা করেন।

মানুষ যেমন তার জন্মের জন্য দায়ী নয়, তেমনি এই সমাজের তরুণেরাও বলতে পারে, তাদের এভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তারা দায়ী নয়। সৌভাগ্যের বিষয়, এর ভেতরেও কিছু তরুণ এ-জাতীয় বড় মানুষ হয়ে ওঠে না। আবার অনেক তরুণ বিদ্রোহ করে বসে বড় মানুষ না হয়ে ওঠার জন্য। আমাদের এখন দরকার এই রকম অনেক বিদ্রোহী মানুষ, যারা বড় মানুষ না হয়ে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার সাধনা করতে পারে।

সত্যিকারের মানুষ হতে সত্যের সাধনা দরকার। এই সততার সাধনা নিজের জন্য, অন্যের কাছে জাঁক করে বলার জন্য নয়। দেখা যায়, যাঁরা আড়ম্বরের সঙ্গে বলেন, ‘আমি কখনো মিথ্যা বলি না’, সেটাই হয় তাঁদের বড় মিথ্যাচার। সত্যিকার মানুষ হতে গেলে প্রথম দরকার আত্মসমালোচনা। আমি কী পারি আর কী পারি না, সেটা দিয়েই শুরু হতে পারে; যা পারি তা যেন আরও ভালোভাবে পারি, এই প্রতিজ্ঞার ভেতর দিয়ে।

মানুষের দৈহিক গুণাগুণের মতোই তার কর্মগুণও তার কোষস্থ জিনসংকেতে থাকে। এই জিনসংকেতের কারণেই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন গুণ বিরাজ করে এবং তা অনেক সময়ই প্রচ্ছন্ন থাকে বা প্রচ্ছন্ন করে রাখার চেষ্টা করা হয়। অথচ এই প্রচ্ছন্ন গুণের চর্চার ভেতর দিয়েই সে সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারে। মানুষ তার গড় ক্ষমতায় অনেক কিছু আয়ত্ত করতে পারে। ধরা যাক, একজন মেধাবী ছাত্র ডাক্তার হতেও পারবে, আবার প্রকৌশলীও হতে পারবে। কিন্তু হয়তো সে জানে না, আইনজীবী হলে সবচেয়ে ভালো হতে পারত। এই সত্যটি মেনে নিলে আইনজীবী হতো তার অধিকতর সত্যিকার মানুষ হওয়ার চর্চা। আবার এই তিনটি বিষয়ের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে হয়তো সে আরও বেশি সাফল্য পেতে পারত। সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রথম দরকার নিজেকে চেনা। সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠার সঙ্গে নানা রকম প্রলোভনও থাকে। কোনো শিল্পীর গান শেখার জন্য কেউ মরিয়া হয়ে ওঠে, অথচ হয়তো সে জানেই না, সেটা তার নিজের ক্ষেত্রই নয়। তার উচিত সংগীতের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য যতটুকু সংগীত শেখা, ততটুকুই। তা ছাড়া ভালো শ্রোতা হওয়ার জন্যও সংগীতের পাঠ নেওয়া যেতে পারে।

প্রতীকী ফাইল ছবি
বন্ধুসভা

তরুণদের কাছে একটি বড় প্রশ্ন থাকে, ‘নিজের ক্ষেত্রটি চিনব কীভাবে?’ এই প্রশ্নে সঙ্গের উত্তরটাও তার নিজের কাছেই থাকে। কিন্তু অনেক সময়ই পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও প্রলোভন তরুণদের বিভ্রান্ত করে। দেখা যায়, প্রত্যেক মানুষের কিছু সহজাত ক্ষমতা থাকে, সেটা সে যত ভালোভাবে পারে, অন্যরা তা পারে না। নিজের ক্ষেত্র চেনার এটি একটি প্রাথমিক স্তর। সে হয়তো মাটির পুতুল তৈরি করে সহজাত দক্ষতায়, হয়তো খুব ভালো গান করে সহজাত গুণে, হয়তো গাছ বা প্রাণীর প্রতি অপরিসীম আগ্রহ আছে। সেটাই তার ক্ষেত্র। সে ভালো অঙ্ক পারে না কিংবা ছবি আঁকতে পারে না, তার জন্য হীনম্মন্যতায় ভোগার কারণ নেই। বরং অহংকারের সঙ্গে তার বলা উচিত, ‘আমি যা পারি, তোমরা তা পার না।’ কখনো দেখা যায়, কারও ভেতরে একাধিক বিষয়ে প্রবল আগ্রহ থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাকেই বেছে নিতে হবে কোনটি তার জন্য অধিকতর প্রযোজ্য। সত্যিকার মানুষ হতে গেলে নিজের ক্ষেত্রকেই আগে চেনা দরকার।

আবার মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে নানা রকম বিষয় জড়িত থাকে। নিজের ক্ষেত্রের চর্চার ভেতর দিয়ে সে নিজেকে সমৃদ্ধ করবে, কিন্তু জীবনের অন্যান্য উপাদানকে তুচ্ছ করে বা অগ্রাহ্য করে নয়। তা যদি করে, তবে সে বড় মানুষ হতে পারবে, কিন্তু সত্যিকারের মানুষ হতে পারবে না। অন্যান্য উপাদানের প্রতি শ্রদ্ধার ভেতরে থাকবে তার মহত্ত্বের পরিচয়। এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় মানুষ সামাজিক জীব। এককভাবে প্রত্যেক মানুষ দুর্বল, কিন্তু সমষ্টিগতভাবে প্রবল। প্রবলভাবে বেঁচে থাকার জন্য, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য অন্যের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে হবে। প্রত্যেক মানুষ হবে নিজের রাজত্বের রাজা, আর অন্যান্য রাজার সঙ্গে মিলে তৈরি করবে একটি অখণ্ড রাজত্ব। সমাজের অন্যান্য রাজার সঙ্গে মিলে যে রাজত্ব গড়ে উঠবে, তার ক্ষমতা হবে অনেক অনেক বেশি।

সত্যিকারের মানুষ হবে বিনয়ী। কারণ, মানুষ পরম সত্যের সাধনা করতে পারে, কিন্তু লাভ করতে পারে না। যদি কেউ পারে তবে সে হয়ে উঠবে ঈশ্বর। সে আর যা-ই হোক, অন্তত মানুষ থাকবে না। অন্য কোনো বিশেষ মানুষের তুলনায় সে হয়তো কোনো কিছু খুব ভালো পারে, কিন্তু সত্যকার অর্থে সে পরম মানে পৌঁছাতে পারেনি বা পারবে না, এই অপারগতার কারণে তার বিনয়ী হতে হবে। বিনয় মানুষকে শৈল্পিক স্তরে নিয়ে যায় এবং সত্যিকারের মানুষ হওয়ার পথে চালিত করে। অহংকার বড় মানুষ করে, কিন্তু সত্যিকারের মানুষের পথ থেকে বিচ্যুত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যে ভালো গান করে সে সুগায়ক, আর যে ভালো গান করে কিন্তু বিনয়ী, সে সংগীতশিল্পী। আমাদের সুগায়কের চেয়ে অনেক বেশি দরকার শিল্পীর। সব ক্ষেত্রেই শিল্পীর দরকার; যিনি নিজেকে সাজাতে পারেন, অন্যকে সজ্জিত করতে পারেন।

প্রতীকী ফাইল ছবি
বন্ধুসভা

সত্যিকারের মানুষ হবে আত্মবিশ্বাসী। বিশ্বমানবসভায় সে অনাহূতও নয়, রবাহূতও নয়। জগতের আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণে তার আবির্ভাব। এই আমন্ত্রণে সে ধন্য, কিন্তু যজ্ঞসভাকে ধন্য করতে হবে তাকেই। যে ক্ষমতা তার আছে, তা দিয়েই সম্ভব। অলৌকিক কোনো প্রপঞ্চে আসক্ত বা বিশ্বাসী হওয়ার দরকার নেই। কর্মের ভেতর দিয়েই সে সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠবে। তবেই সে প্রবহমান অনন্ত আনন্দধারায় স্নাতক হতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘড়ায় তোলা জলে স্নান করার দরকার পড়বে না।

মানুষের উপলব্ধি থেকে জন্ম নেয় অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতা দেয় ধারণা, আর বহুবিধ ধারণা থেকে জন্ম নেয় জ্ঞান। জ্ঞানের ব্যবহারিক কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে পাওয়া যায় বুদ্ধিমত্তা। সত্যিকার মানুষ হতে গেলে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দরকার বোধ। বুদ্ধিমত্তার দ্বান্দ্বিক দশা থেকেই জন্ম নেয় বোধ। বোধই ধারণ করে ন্যায়-অন্যায়, নীতি-দুর্নীতি। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বোধের রূপ পাল্টায় বটে, কিন্তু কিছু বোধ থাকে যা চিরায়ত, যা সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য। যেমন: সততার বোধ, অহিংসার বোধ, পরশ্রীকাতরতামুক্ত বোধ ইত্যাদি।

এসবের ভেতর দিয়েই একজন মানুষ হয়ে উঠবে সত্যিকারের মানুষ। এই মানুষ সাদাকে সাদা বলার সাহসিকতা দেখাবে, পক্ষপাতদুষ্টতার দ্বারা নিজেকে কলুষিত করবে না। আত্মসমালোচনা ও আত্মসংশোধনের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠবে সত্যিকারের মানুষ। তা যেদিন হবে, সেদিনই আমরা গাইতে পারব মানুষের জয়গান।