সংসার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জুলেখা বেগমের বড় ছেলে রাকিব এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। মাস দুয়েক পর তাঁর পরীক্ষা। জুলেখা বেগম নিয়ম করে ছেলেকে প্রতিদিন দুধ, ডিম, বাদাম খাওয়াচ্ছেন। একটা সেদ্ধ ডিম নিয়ে ছেলের রুমে ঢুকেই দেখেন রাকিব শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছে। মাকে দেখেই সে বলে উঠল, তোমাকে কতবার বলেছি, অনুমতি ছাড়া আমার রুমে ঢুকবে না।

জুলেখা ছেলের এই আচরণ উপেক্ষা করে বললেন, তোমার তো এখন মোবাইল চালানোর কথা নয়, পড়ার কথা, আগামীকাল তোমার ক্লাস টেস্ট আছে, সিলেবাস শেষ করেছ? দেখাও আমাকে। রাকিব এবার উত্তর দেয়, তোমাকে দেখাব? তুমি আমার পড়াশোনার কী বুঝবে? নিজে তো মনে হয় না কখনো কলেজে গিয়েছ। জুলেখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে এলেন।

দুপুরের রান্না চুলায় চড়াতে অতীতের স্মৃতি মনে করতে লাগলেন। এমন এক মেঘলা দিনে রাকিবের বাবার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন৷ অসম্ভব ভরসা ছিল ওই মানুষটার প্রতি। বাবা চেয়েছিলেন জুলেখা অনেক বড় ব্যারিস্টার হবে। আর তিনি ভেবেছিলেন, আসগর সাহেবের হাত ধরে তাঁর ওই স্বপ্ন পূরণ হওয়া সম্ভব। আসগর মানে রাকিবের বাবা তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন।

দুজনেরই বয়স অল্প, হাতে ছিল না টাকা। ছিল না পাশে পরিবারের লোকজনও। আসগর সাহেব কোনোমতে একটি ছোটখাটো চাকরি জোগাড় করেন। এক রুমের বাসায় শুরু হয় ছোট্ট সংসার। পড়াশোনার কথা অনেকবার বলেছিলেন জুলেখা তাঁর স্বামীকে; আসগর বলতেন, ‘কিছুদিন অপেক্ষা করো।’ অপেক্ষা করতে করতে একদিন হঠাৎ করেই জুলেখা টের পেলেন তাঁর মধ্যে অন্য একটি প্রাণ বেড়ে উঠছে। এরপর চলে গেল আরও দুই বছর।

একদিন আসগরকে না জানিয়েই তিনি এক বান্ধবীর সাহায্য নিয়ে একটি কলেজে ভর্তি হয়ে আসেন। আসগরকে জানালে তিনি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। একদিকে সংসার-বাচ্চা, আরেক দিকে পড়াশোনা, সঙ্গে অর্থনৈতিক মন্দা, সব মিলিয়ে বেশ কষ্টে দিন যাচ্ছিল তাঁদের। এসবের মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প ছিল জুলেখার। সামনেই বোর্ড পরীক্ষা, একদিন হঠাৎ করেই আসগর এসে বললেন, তিনি ভালো একটা চাকরি পেয়েছেন সিলেটে। সংসারে অভাব আর থাকবে না। এ মাসেই তাঁরা সিলেটে শিফট হবেন, তাড়াতাড়ি গোছগাছ শুরু করতে হবে।

জুলেখা শুনে বললেন, আমার তো পরীক্ষা! আসগর উত্তর দিলেন, ছেলে বড় হচ্ছে; তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় তুমি পড়াশোনা করে কী করবা? তা ছাড়া আমার বাসার কেউ চান না যে আমার বউ আমার থেকে বেশি পড়াশোনা করুক। তুমি চাইলে রান্নাবান্না কিংবা সেলাইয়ের কোর্স করতে পারো। সেদিনের পর থেকে জুলেখা বেগম আর কখনো পড়াশোনা করার কথা ভাবেননি। এগুলো ভাবতে ভাবতে তিনি খেয়ালই করেননি আসগর সাহেব কখন ছোট ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে ফিরেছেন। আসার সময় তাঁর জন্য প্রিয় বেলি ফুলের মালা এনেছেন। আচ্ছা! এতকিছুর পরও কি এই লোকটার প্রতি তাঁর ভালোবাসা বা ভরসা একটুও কমেছে? না কমেনি। এই মানুষটাকে তিনি এখনো অসম্ভব ভালোবাসেন এবং চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন। এ লোক যা করেছেন, তাঁদের সংসারের জন্য করেছেন, তিনি তাঁর সন্তানদের জন্য শ্রেষ্ঠ বাবা। এক রুমের সংসার থেকে এখন তাদের ডুপ্লেক্স বাড়ি, দুই ছেলে নিয়ে সুখে আছেন।
তিনি তো মা, এর বাইরে তাঁর আর কী চাওয়ার আছে? হয়তো চাওয়ার অনেক কিছু ছিল! সময় থাকতে সেগুলো পূরণ করা হয়নি। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে আক্ষেপও কাজ করে। তবুও জীবন চলে যায়। সংসারে দায়িত্ব যে এখন বেড়ে গেছে!

লেখক: প্রচার সম্পাদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা