শোনো ২০২২...

প্রতীকী ছবি
সংগৃহীত

শোনো ২০২২, তোমাকে বলতে চাই কতগুলো গোপন বেদনার কথা।

জানো, একসময় আমিও মানুষ ছিলাম। কেন? তুমি কি এখন মানুষ না? হয়তো। কিন্তু সেই মানুষ না। যিনি সমস্ত পৃথিবীর হয়ে দুঃখ পান। সড়কে শিক্ষার্থীর মৃত্যু দেখে তো আমি দুঃখ পাই না। বিনা বিচারে মৃত্যু হলে তো দুঃখ পাই না। দুই পক্ষের গুলিতে মৃত্যু হলে দুঃখ পাই না।

ব্যাংকের টাকা লুট হলে প্রতিবাদ করি না। বিদেশে টাকা পাচার হলে প্রতিবাদ করি না। প্রকল্পের টাকা চুরি হলে প্রতিবাদ করি না। তাই তো বলছিলাম একসময় আমিও মানুষ ছিলাম।

আমার থেকে নিষ্ঠুর আর কে আছে বলো? দাউ দাউ করে মানুষ পুড়তে দেখে কষ্ট পাই না। চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও ঝরে না। চারদিকে এত অন্যায়, অমানবিকতা দেখি। অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা দেখি। গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণের কথা শুনি। হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কথা শুনি। এসব তো নীরবেই মেনে নিই। লজ্জায় মাথা নত করি না। তাই তো বলছিলাম, একসময় আমিও মানুষ ছিলাম।

২০২১–কে অনেক না পাওয়ার কথা, হারানোর কথা, বেদনার কথা বলেছিলাম। কেউ কথা রাখেনি। শোনো ২০২২। কেউ কথা রাখে না। এই যে প্রকৃতিতে এত শীত। এত বরফ। কিন্তু জানো। এর চেয়ে শীতল হলো মানুষ। বরফ গলে যায়। মানুষের মন গলে না।

যে সময় তোমার সঙ্গে কথা বলছি, ঠিক তখনই প্রচণ্ড শীতে কাঁপছে সারা দেশ। কষ্ট পাচ্ছে কত মানুষ। আর আমি অনেকগুলো কাপড় পরে বলছি, আহা কী শীত! কই, আমি তো এসব মানুষের জন্য কিছু করছি না। তাই তো বলছিলাম, আমি আর আগের মতো নেই।

একবার ভাবো আমাদের শিশুদের কথা! আজ আর তাদের শৈশব বলে কিছু নেই। তোমার জানার কথা না। আমরা তখন শৈশবে। আমরা জানি, আমাদের শৈশব কত আনন্দের ছিল! তখন পড়ালেখা ছিল অকাজ। কাজ ছিল গ্রীষ্মের দুপুরে ঢিল ছুড়ে আম পাড়া। পাখি ধরা। নদীতে সাঁতার কাটা। ঘুড়ি ওড়ানো। হাডুডু, ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন আরও কত কী খেলা। এ-পাড়ায় ও-পাড়ায় ঘোরাঘুরি। রাতে দাদি-নানির কাছে গল্প শোনা। জোনাকি ধরা। সে এক দারুণ সময়! এখনকার শিশুরা সেটা ভাবতেও পারে না।

আমরা বড়রা কেড়ে নিচ্ছি এদের শৈশব। প্রচণ্ড শীতের ভোরে বইয়ের বোঝা নিয়ে স্কুলে যায়। স্কুল থেকে কোচিং। কোচিং থেকে ক্লান্ত হয়ে বাসায়। এরপরও একটু শান্তি নেই। বাসায় ফিরে দেখে সোফায় বসে আছেন শিক্ষক। কেউ ভাবছে না পড়ালেখার মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ খেলাধুলা, আনন্দ-বিনোদন।

অনেক দিন পর আবার মনে পড়ছে সেই নিষ্পাপ দুটি শিশুর কথা। তারা ছিল দুই ভাই। অরণি ও আলভি। একদিন নিজের মা তাদের গলা টিপে হত্যা করেন! অপরাধ, পড়াশোনা রেখে একটু খেলতে চায়। এখনো হয়তো ঢাকার বনশ্রীর বাতাসে মিশে আছে তাদের মৃত্যুর গন্ধ।

তুমিই বলো ২০২২, কীভাবে এটা মেনে নেওয়া যায়? কিন্তু আমি তো নিয়েছি। শিশুদের শৈশব হরণ, জিপিএ-৫-নির্ভর শিক্ষার জন্য আমার তো মন খারাপ হয় না। একবারও রাস্তায় নেমে বলি না, এ শিক্ষা চাই না। এ জন্যই তোমাকে বললাম, একসময় মানুষ ছিলাম। আরও অনেক কষ্টের কথা আছে। সব কি আর বলা যায়? দেখ, আগে আমরা গরিব ছিলাম। কিন্তু একে অন্যের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ। মায়া ছিল। ছিল আবেগ-অনুভূতি। সুখে-দুঃখে একে অপরের পাশে থাকতাম।

এরই মধ্যে হলাম মধ্য আয়ের দেশ। হাঁটছি উচ্চ আয়ের দিকে। ঐশ্বর্য বাড়ছে। কিন্তু কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সহমর্মিতা। কাছে ও পাশে থাকার মানসিকতা। দূর থেকে আরও দূরে যাচ্ছি। আগের সেই মায়া-মমতা, কাছে আসা, পাশে থাকা, ভালোবাসা সব যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

মৃত্যুর চেয়ে বেদনার আর কী হয়? মৃত্যু হলো শব্দহীন জগতের প্রতিধ্বনি এক নৈঃশব্দ্য জগৎ। ঠিক যে সময় কড়া নাড়ছে খ্রিষ্টীয় নববর্ষ কেউ কি জানত সেই সময় কী ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা অপেক্ষা করছে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে। গভীর রাতে লঞ্চের ভয়ানক আগুনে মৃত্যু হলো অনেকগুলো তাজা প্রাণের। বাঁচার আশায় যারা ঝাঁপ দিয়েছিল নদীতে, তাদের অনেকে বাঁচতে পারেনি।

শোন ২০২২। ২০১৯, ২০ ও ২১-এর কাছে প্রার্থনা ছিল আর যেন আগুনে পুড়ে মানুষের মৃত্যু না হয়। কিন্তু ওই যে বললাম কেউ কথা রাখে না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে পড়ছে ফাতেমা তুজ জোহরা ও রেনুমা তাবাসসুমের কথা। ইতিহাসে লিখে রাখার মতো ভালোবাসা ছিল দুজনের মধ্যে।

শিল্পকলায় অনুষ্ঠান শেষে ফিরছিল বাড়ি। ফেরার পথে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। পৃথিবীতে বেঁচে ছিল একসঙ্গে। আর মরণও হলো একসঙ্গে। এটা ছিল ২০১৯-এ পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুন লাগার এক নিষ্ঠুর ঘটনা। সে আগুনে প্রায় ৭৮ জন মানুষ প্রাণ হারিয়ে ছিল।

প্রতীকী ছবি
এএফপি

তুমি জান না ২০২২। জানে তোমার অগ্রজেরা। শহরে মাঝেমধ্যে বস্তিতে আগুন লাগে। যতটা না আগুন লাগে এর থেকে অনেক বেশি লাগানো হয়। বস্তির আগুনের অনেক গল্প আছে। কখনো এটা ক্ষমতার আগুন, কখনো দখলের আবার কখনো বা ভবন নির্মাণের আগুন। সে আগুন যেমনই হোক, যারা নিঃস্ব হয়ে পথে বসে, প্রিয়জন হারায়, তাদের জীবনের স্বপ্ন আর ফিরে আসে না কোনো দিন। প্রতিবছর এমনি করে বিপন্ন করে দেয় হাজারো মানুষের স্বপ্ন। তাই প্রতিবারই তোমাদের কাছে প্রার্থনা করি যেন আগুন না লাগে। কে শোনো কার কথা।

শোন, অন্যায় অমানবিকতা দেখতে দেখতে না, পাথর হয়ে গেছি। আর যেন পারি না। তারপরও এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আরও পাথর করে দেয়। এই তো মাত্র এক সপ্তাহ আগের কথা। স্বামী–সন্তান নিয়ে এক নারী বেড়াতে গিয়েছেন কক্সবাজার। আর সেখানে শিকার হলেন দলবদ্ধ ধর্ষণের। গণপরিবহনে ধর্ষণ হয়, রাতের অন্ধকারে ধর্ষণ হয়। কিন্তু কক্সবাজারের মতো সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গিয়ে যখন ধর্ষণ হয়, তখন আর নিজেকে ইচ্ছা করে না মানুষ ভাবতে। তোমাকে মনে করিয়ে দিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রীটির কথা। সেটা ২০২০-এর জানুয়ারির ৭ বা ৮ তারিখ হবে। সেদিন ঘরে ফিরতে তার সন্ধ্যা হয়ে যায়। হঠাৎ বাস থেকে তিনি নেমে পড়েন ভুল জায়গায়। সেই ছোট্ট ভুলই তাঁর জীবনের স্বপ্নগুলো, আনন্দগুলো ভেঙে চুরমার করে দেয়। সে রাতে ধর্ষণের শিকার হলেন মেয়েটি।

প্রায় সব সময় তোমাদের মিনতি করে বলি, গরিব মানুষদের দেখে রেখ। কষ্ট দিও না। তোমাদের আসলে অনেক মোটা চামড়া। কেউ কথা রাখ না। কথা শোন না। আমার দাদি বলত, আগের হাল যেভাবে যায়, পরের হালও সেভাবে যায়। প্রতিবছর বলি, গরিব মানুষ যা খেয়ে বাঁচে সেই চাল, ডাল, তেল, লবণ, আলু, পেঁয়াজের দাম যেন না বাড়ে। আবার সেই পেঁয়াজ! তুমি কি জান, একবার এক কেজি পেঁয়াজের দাম হয়েছিল ৩০০ টাক! দোহাই তোমার এ রকম মাথায় বাড়ি দিও না।

ইতিহাসে ২০২০-২১-এর নাম লেখা থাকবে এক ভয়াবহ দুর্যোগের কাল হিসেবে। করোনার মতো এক বিরল প্রজাতির মৃত্যুদূত সবার ঘাড়ে চেপে বসেছে। ২০২০-এর ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে। সেই শুরু। তারপর মন্ত্রী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, চিকিৎসক, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, পুলিশ, আমলা, সাংবাদিক, ব্যাংকার, ব্যবসায়ীসহ এমন কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ নেই, যাঁদের করোনায় মৃত্যু হয়নি।

হে বন্ধু ২০২২, একটা অনুরোধ। তুমি তোমার অগ্রজদের মতো হয়ো না। তুমি ভালো হয়ে এসো। আপন হয়ে এসো। বন্ধু হয়ে এসো। তোমাকে নিয়ে যেন ২০২৩-এর কাছে অভিযোগ করতে না হয়।

পৃথিবীর মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, মত-পথ হয়তো আলাদা। কিন্তু সবার দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, অশ্রু এক। সবারই রক্তের রং লাল। স্রষ্টার কাছে সবাই সমান। কারও প্রতি তাঁর বৈষম্য নেই। জগতের সবাইকে তুমি দেখে রেখো। কাউকে কষ্ট দিয়ো না। শুধু এটুকু প্রার্থনা তোমার কাছে।

আশফাকুজ্জামান: কলাম লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক