শূন্যতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হাবিব সাহেবের শরীরটা একদম ভালো যাচ্ছে না। গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। বমি বমি ভাব। অফিস থেকে তিন দিনের জন্য ছুটি নিলেন। হাবিব সাহেব সুগার মিলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। তিন ছেলে-মেয়ে। বড় ছেলে জিহান বাংলায় অনার্স প্রথম বর্ষ, মেজ ছেলে জিসান দশম শ্রেণিতে, ছোট মেয়ে জয়া সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রী রোকেয়া পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। হাবিব সাহেব আর বিয়ে করেননি। তিন সন্তানকে বুকে আগলে রেখে সংসার করে যাচ্ছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ভীষণ ভেঙে পড়েন তিনি।

কলেজ থেকে জিহান বাসায় ফিরল। বাবাকে দেখেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বাবা? আজ অফিসে যাওনি? বাবা বললেন, না। শরীরটা বেশ কিছু দিন হলো ভালো যাচ্ছে না। কই, আমাকে তো কিছু বলোনি? বাবা বললেন, সামান্য জ্বর, ঠিক হয়ে যাবে। গায়ে হাত দিয়েই চমকে ওঠে জিহান। একি! প্রচণ্ড জ্বর! জিহান সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেল। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বললেন, এই ওষুধগুলো ঠিকমতো খাওয়াবেন। সাত দিন পর নিয়ে আসবেন।

দিন দিন হাবিব সাহেবের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। জিহানের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। মা বেঁচে নেই পাঁচ বছর হয়ে গেছে। বাবা কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। যদি বাবার কিছু হয়ে যায়...।
কত কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজেকে খুব অপরাধী ভাবছে জিহান। কেন বাবাকে এত দিন বোঝার চেষ্টা করিনি? কেন এক দিনও বুকে জড়িয়ে ধরে বলিনি, বাবা, তুমি কেমন আছো? তাঁর শূন্যতাকে কেন উপলব্ধি করার চেষ্টা করিনি? বটবৃক্ষের মতো নিজেকে উজাড় করে আমাদের মাথার ওপর ছায়া দিয়ে গেছেন। নীল বেদনাগুলো ঢেকে রেখে অধরের কোণে হাসি দিয়ে মাথায় হাত রেখে বলেছেন, এগিয়ে চলো, এই তো আমি আছি তোমাদের সাথে। হাত দুটি সহানুভূতির, মমত্ববোধের, নির্ভরশীলতার।

বারবার জিহান নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমি তো পারতাম বাবার কাঁধে হাতটা রাখতে। একটু সুখের কাজল মেখে দিতে। কখনো খেয়াল করিনি বাবার পায়ের স্যান্ডেলটা ছিঁড়ে গেছে কি না। শার্টের নিচের গেঞ্জিটা ছেঁড়া কি না। বাবা সবাইকে যখন ঈদের পোশাক কিনে দিতেন, কখনো এসে বলিনি, বাবা তোমার পাঞ্জাবিটা কই? তোমার পছন্দের খাবারগুলো কী? কখনো জানতেও চাইনি। বাবার নির্ভরশীলতার জায়গাটা কখনো খোঁজার চেষ্টা করিনি। আর বাবা সব সময় আমাদের আবদার পূরণ করে গেছেন। পরিবারের সবাইকে ভালো রেখেছেন, আর আমরা সবাই মিলে একজন বাবাকে ভালো রাখতে পারিনি। বাবার শিয়রে বসে জিহান বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে আর ঈশ্বরকে ডাকছে। হে আমার ঈশ্বর, আর একটিবার সুযোগ দাও। বাবাকে সেবা করার, ভালো রাখার। আমি কথা দিচ্ছি, বাবা সেরে উঠলেই আমি তাঁর দায়িত্ব নেব। কষ্ট পেতে দেব না।

সকাল ১০টায় চিকিৎসকের ফোন। রিপোর্ট নিয়ে আসার জন্য হাসপাতালে গেল জিহান। চিকিৎসকের মুখ দেখেই জিহানের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। জিহান চিকিৎসককে ধরে বলল, বাবা ঠিক আছে তো? চিকিৎসক প্রথমে কিছু বললেন না। পরে হাতে রিপোর্ট দিয়ে বললেন, আমরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝি না। সময়ের কাজ সময়ে না করলে খেসারত দিতে হয়। জিহানের চারপাশটা আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে আসে। আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আসে। তাঁর বাবার ব্লাড ক্যানসার। চিকিৎসক জানিয়েছেন, লাস্ট স্টেজ, সময় বেশি দিন নেই।

এর কয়েক দিন পর বাবাও মায়ের কাছে চলে যান। জিহান খুব ভেঙে পড়ে। ভেবে পায় না এখন কী করবে। সংসার চালানো কত কষ্টের, এখন সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে। নিজেকে বলে আরও শক্ত হতে হবে। ঈশ্বরের কাছে সহায়তা চায়। ছোট দুই ভাইবোনের সব দায়িত্ব এখন তার ওপর। মা–বাবা নেই। একের পর এক চ্যালেঞ্জ পার করতে হচ্ছে। বাবার রেখে যাওয়া কিছু টাকা এবং নিজের টিউশনিকে আঁকড়ে ধরে খুব কষ্টে সংসার চালাতে থাকে জিহান। রাতের আঁধারে বারবার বাবার কথা মনে করে কাঁদে। বাবার প্রতি অবহেলা, অনাদর বারবার তাকে দংশিত করে। এখন সে উপলব্ধি করতে পারে সংসারে মা–বাবাকে ভালো রাখার জন্য সন্তানের কতটা ভূমিকা দরকার। একটুখানি ভালোবাসা, মায়ামমতা, হাসিমুখে রাখা, নিয়মিত খোঁজখবর নেওয়া, এতটুকুই চাওয়া তাঁদের। এই প্রাপ্তিটুকু যেন মা–বাবার স্বর্গীয় উদ্যান।

লেখকের ঠিকানা: কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ