শিক্ষা না বদলালে দেশ বদলাবে না

অপরাজেয় বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রতিবারের ন্যায় এবারও যুক্তরাজ্যের শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কিউএস (কোয়াককোয়ারলি সায়মন্ডস) তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে ‘ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিংস-২০২২’ প্রকাশ করেছে। কিউএস পৃথিবীর ১৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর মতামত প্রকাশ করেছে, যা ছয়টি বিষয় সামনে রেখে তৈরি করা হয়েছে। ছয়টি বিষয় হলো প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক খ্যাতি, চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত। এই ছয় ক্যাটাগরিতে মোট ১০০ নম্বরের ওপর র‍্যাঙ্ক প্রকাশ করা হয়েছে।

চলুন দেখা যাক, তারা কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেটিং তৈরি করেছে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক খ্যাতির ওপর। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান কেমন এবং এ ব্যাপারে কেমন পরিচিতি আছে, তা ছিল বিবেচ্য বিষয়। কিউএস কর্তৃপক্ষ এ বিভাগে প্রায় ১,৩০,০০০ বিশেষজ্ঞ থেকে জরিপ পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং এ অংশের জন্য নির্ধারিত নম্বর ছিল ৪০।

দ্বিতীয়টি হলো চাকরির বাজারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচিতি। একজন ছাত্র পড়াশোনা শেষ করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করবেন। এই বাজারে প্রতিযোগিতা করার জন্য তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে কীভাবে প্রস্তুত করে তুলছে, তা ছিল এই শাখার মূল বিষয়। তারা প্রায় ৭৫,০০০ চাকরিদাতাকে জরিপের মাধ্যমে জিজ্ঞেস করেছেন, কোন কোন প্রতিষ্ঠান থেকে আপনি একজন দক্ষ, উদ্ভাবনী ও কর্মঠ গ্র্যাজুয়েট চান। এ সেকশনের জন্য নম্বর হলো ১০।

এরপর শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত। এখানে তারা মনে করছে, পর্যাপ্ত শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবেন। শিক্ষার্থীদের যথার্থ পাঠদান, শিক্ষাসামগ্রী প্রদান ও পর্যবেক্ষণের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত অনেক গুরুত্ব বহন করে। এখানে নম্বর রাখা হয়েছে ২০।

চতুর্থ হলো শিক্ষকপ্রতি গবেষণা উদ্ধৃতি। শিক্ষকদের প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণাপত্র কতটুকু উদ্ধৃত হয়েছে, অন্যান্য গবেষকেরা তাঁদের গবেষণায় কতবার এই পত্র বা আর্টিকেল ব্যবহার করেছেন, তা হলো বিবেচনার বিষয়। কিউএস মনে করে, অধ্যাপনা বা পাঠদান যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র এবং গবেষণা তার ফসল। গবেষণা উদ্ধৃতি সংগ্রহের জন্য তারা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিগত পাঁচ বছরে প্রকাশিত আর্টিকেলের উদ্ধৃতির রেকর্ড গ্রহণ করেছে। এ বছর কিউএস কর্তৃপক্ষ এলসেভিয়ারস স্কপাসের ডেটাবেইস থেকে প্রায় ১৪.৭ মিলিয়ন পেপার থেকে ৯৬ মিলিয়ন উদ্ধৃতির মূল্যায়ন করেছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বিশাল কাজ। এখানেও নম্বর রাখা হয়েছে ২০।

সবশেষ আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত। কিউএস কর্তৃপক্ষ মনে করে, আন্তর্জাতিক মানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সুযোগ-সুবিধা থাকে, যা বৈশ্বিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আকর্ষণ করে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রমাণ করতে পারে যে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আছে এবং তারা বিশ্বমানের শিক্ষা দিয়ে থাকে। এখানে নম্বর রাখা হয়েছে ৫ করে মোট ১০।

এবার দৃষ্টি যাক আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। এ বছর বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এ র‍্যাঙ্কে স্থান পেয়েছে, যার দুইটি পাবলিক আর দুইটি প্রাইভেট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাবি ও বুয়েট ৮০০-১০০০–এর মধ্যে আর ব্র্যাক ও নর্থ সাউথ ১০০১-১২০০–এর মধ্যে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন ভাল র‍্যাঙ্কে যেতে পারছে না, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে হতাশা আছে, ক্ষোভ আছে, আছে তুচ্ছ–তাচ্ছিল্যও। কিন্তু আমরা কেউ এর গভীরে গিয়ে দেখি না আসলে সমস্যা কোথায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ট্রল, সমালোচনা ও কটাক্ষের শিকার হয়। এটা একেবারেই স্বাভাবিক। দেশের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর কাছে মানুষের প্রত্যাশা সব সময় বেশি। তা ছাড়া বিভিন্ন স্তরে যাঁরা চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন, তাদের একটি বড় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

আসুন দেখি, কেন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে স্থান পাচ্ছে না।

এক. আন্তর্জাতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত। আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয় না। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এর কোনো সুযোগও নেই। যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করেও থাকে, তা একেবারেই নগণ্য। বিদেশি শিক্ষকেরা মাঝেমধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসেন। স্বল্প মেয়াদের জন্য তাঁরা এখানে গবেষণা করেন ও ক্লাস নেন। যে পরিমাণ বিদেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আসেন, তা কিউএস মূল্যায়নে আসার মতো নয়। কাজেই এখানে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১০-এর মধ্যে কোনো নম্বর পাচ্ছে না। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান যে অবকাঠামো বা অবস্থা, তার পরিবর্তন করতে হলে আমাদের অবশ্যই বিদেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আনার ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশকে আমরা ডিজিটাল বলছি, অথচ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ, ডিন অফিস ও জার্নালগুলোর ওয়েবসাইট হালনাগাদ করা নেই। এমনকি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মূল ওয়েবসাইটও আপডেট নয়। আমি মনে করি, দেশের শিক্ষার এই করুণ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে হলে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে।

দুই. শিক্ষকপ্রতি গবেষণা উদ্ধৃতি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার যথেষ্ট সুযোগ নেই, এটা আমরা জানি। তারপরও যেসব গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়, তার একটি বড় অংশ প্রকাশিত হয় দেশের জার্নালগুলোয়। এসব জার্নালের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওয়েবসাইট নেই, থাকলেও হালনাগাদ করা নেই। অল্প কিছু পেপার বাইরের দেশে প্রকাশিত হয়, যা দিয়ে পূর্ণ নম্বর পাওয়া সম্ভব নয়। এখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ২০-এ ৫ পর্যন্ত পেতে পারে।

তিন. শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একটি ক্লাসে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী থাকেন, তা বিশ্বে নজিরবিহীন। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একটি ক্লাসে গড়ে ১০০-১৫০ শিক্ষার্থী ক্লাস করেন। আর একজন শিক্ষক সবার জন্য লেকচার দেন। ইউজিসির নির্দেশনা অনুসারে আমাদের দেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত (টিএসআর) সর্বোচ্চ ১:৩৪। আর বৈশ্বিক অনুপাত হলো ১ জন শিক্ষকের বিপরীতে ১০ জন শিক্ষার্থী। কিন্তু আমাদের দেশে এই হার প্রয়োগ করা শুধু অসম্ভবই নয়, অকল্পনীয়ও। তাহলে এখানেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ২০-এর মধ্যে কোনো নম্বর পাচ্ছে না। পেলেও পাঁচের বেশি পাওয়ার কথা নয়।

চার. চাকরিদাতার কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম। এখানে ঢাবি ও বুয়েট সবার চেয়ে এগিয়ে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। রেটিংয়ে তা আমরা দেখতে পেয়েছি। আমাদের দেশে চাকরিদাতাদের প্রথম পছন্দ বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর প্রাইভেটের মধ্যে নর্থ সাউথ ও ব্র্যাক ভালো করছে। এ হিসাবে ঢাকা ও বুয়েট ১০–এর মধ্যে ১০ পেলেও অন্যরা কিন্তু তা পাবে না।

পাঁচ. প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাখ্যাতি। আমাদের দেশে মেডিকেলের পরই সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর বুয়েটে পড়তে চান। কাজেই এদের প্রাতিষ্ঠানিক খ্যাতি আছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এখানে প্রতিযোগিতায় আছে। মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ এখনো প্রাইভেটের ওপর আস্থা রাখতে পারে না। কিন্তু ধারণার বিবর্তন হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে। এখানে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভালো নম্বর পাবে। ঢাবি ও বুয়েট ৪০–এর মধ্যে ৪০–ও পেতে পারে। তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের মোট নম্বর দাঁড়াল ৬০। কিন্তু বাস্তবে এটা ঘটেনি। কিউএস সর্বশেষ নম্বর দিয়েছে কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়কে, যার র‍্যাঙ্ক ৪৯৪ আর প্রাপ্ত নম্বর ২৪.১। যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ৫০০–এর পরে আছে, তারা কোনো নম্বর পায়নি।

এখন আমাদের করণীয় কী? দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ২০৪১ সালে একটি উন্নত রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে থাকবে? সমাজের গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য আলোকিত মানুষের দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুর্বল অবকাঠামো, শিক্ষার আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা দিয়ে আলোকিত ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি সম্ভব নয়। এখনই আমাদের সরকারকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে মনোযোগ দিকে হবে। প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে। গবেষণার ফান্ড ও বিবিধ সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। পিএইচডিধারী যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। প্রধান চার বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর থেকে শিক্ষার্থীসংখ্যা কমাতে হবে। সবচেয়ে জরুরি, বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে এবং তাঁদের স্কলারশিপের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা না বদলালে দেশ বদলাবে না। এখনই এসব নিয়ে ভাবতে হবে। তা না হলে, একদিন এই শিক্ষার মান আপনাকে ভাবাবে, জাতিকে ভোগাবে।

লেখক: ডক্টরাল গবেষক, ফেরারা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালি ও সহকারী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]