মর্তুজ আলীর শর্ষেখেতে ভূত! ভয়ংকর রকমের কুৎসিত ভূত! বাপ রে বাপ, কী বীভৎস তার অট্টহাসি! ভূতটার সেই হাসি সুনামির মতো ঢেউ তুলেছে দেবীপুর গ্রাম থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায়। লাখ লাখ মানুষ দেখছে সেই ভিডিও। ভূতের ভিডিও! ফেসবুক লাইভের সেই ভিডিও দেখে অনেকের কলিজার পানি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। দেবীপুর গ্রাম এখন দেশবাসীর কাছে খুব পরিচিত এক নাম। এক রাতেই দেবীপুরকে সবাই ‘ভূতের গ্রাম’ হিসেবে চেনে।
এক দিন আগেও দেবীপুর গ্রামে দূরদূরান্ত থেকে শত শত মানুষ আসত। শর্ষেখেতে হলুদ রঙের ফুল দেখে তারা বিমোহিত হতো। সবুজ মাঠে হলুদের রাজত্ব, মৌমাছির গুঞ্জন। পেছনে বিস্তৃত নীল আকাশ—সব মিলিয়ে স্বর্গীয় এক দৃশ্যপট। সেই দৃশ্যকে নিজ চোখে দেখার জন্য প্রত্যন্ত এই গ্রামে ভ্রমণপিয়াসী মানুষের ঢল নামত। দেবীপুরে নানান বয়সের মানুষের সমাগম হতো। এত মানুষের সমাগম দেখে গ্রামের রাস্তার দুই পাশে গড়ে উঠেছে অস্থায়ী দোকানপাট। পাঁচ-ছয়টি খাবারের দোকান, দুটি হস্তশিল্পের দোকান ও তিন চারটি মণ্ডা-মিঠাইয়ের দোকান। সারি সারি সেই দোকানে তরুণ-তরুণীদের আনাগোনাই বেশি থাকে। দর্শনার্থীরা সরিষাখেতে দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে নানান অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলেন। সরিষাখেতে তোলা ছবিগুলো তারা ফেসবুকে আপলোড করেন। সেই পোস্টগুলো লাইক কমেন্টের বন্যায় ভেসে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে দেবীপুর রাতারাতি এখন ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেবীপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ জলে ছোট্ট ছোট্ট ডিঙিতে চড়ে শেষ বিকেলের সোনাঝরা আলোয় অবগাহন করেন দর্শনার্থীরা। সব মিলিয়ে অনন্য এক দেবীপুরকে দেখতে আসেন হাজার হাজার দর্শনার্থী।
মর্তুজ আলী এসব দেখেন। ভালোই লাগে তার। কত রংবেরঙের মানুষ। কত বিচিত্র তাদের বেশভূষা। মর্তুজ আলী একটা বিষয় খেয়াল করছেন যে দর্শনার্থীদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি। তাদের বেশির ভাগই মোটরসাইকেল চেপে আসেন। আসার সময় ভোঁ ভোঁ শব্দে গ্রামের কাঁচা মাটির রাস্তায় ধুলা উড়িয়ে আসেন। নীরব–নিস্তব্ধ সেই দেবীপুর এখন সব সময় মানুষে মানুষে গমগম করে। মোটরসাইকেল, টমটম, সিএনজির শব্দের জন্য ইদানীং পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ শোনা যায় না। কিছু পাখি মনে হয় দূরে কোথাও চলে গেছে। গ্রামের বউ-ঝিয়েরা বাড়ির কাজকাম রেখে আনবাড়িতে দাঁড়িয়ে শহুরে মানুষের তামাশা দেখেন।
দেবীপুর গ্রামের প্রান্তিক কৃষক মর্তুজ আলী সবকিছু দেখেন। নিবিড়ভাবে দেখেন। চিরচেনা গ্রামটাকে তার কাছে আজকাল অচেনা মনে হয়। প্রথম প্রথম মর্তুজ আলীর কাছে বিষয়টা ভালোই লাগত। কোনো দর্শনার্থী গ্রামে এলে গ্রামের সবাই তাদের অতিথি হিসেবে আপ্যায়ন করত। প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করত। কিন্তু এখন গ্রামবাসী আর সহ্য করতে পারছে না। দিন দিন দর্শনার্থীদের অত্যাচার ও যন্ত্রণার মাত্রা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। সরিষার গাছগুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। শিনা টানটান করে দাঁড়ানো সেই সবুজ সরিষার গাছগুলো দর্শনার্থীরা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। খেতের দিকে চোখ গেলেই মর্তুজ আলীর বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। টনটন করে বুকটা ব্যথা করে। করিম মোল্লার কাছ থেকে ধার করা টাকার সুদও দ্রুত বাড়ছে।
বর্গাচাষি মর্তুজ আলী এ বছর তিন বিঘা জমিতে ভালো জাতের সরিষার চাষ করেছেন। কৃষি অফিসার নিজে এসে দেখে পরামর্শ দিয়ে গেছেন তাকে। সেই অনুসারে গাছের দেখাশোনা করছেন তিনি। তরতর করে বড় হয়েছে গাছগুলো। কলাবতী গাছের মতো হলুদ ফুলে ভরে গেছে সরিষাগাছের শাখাপ্রশাখা। গাছের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এবার সরিষার বাম্পার ফলন হবে। আজকাল মর্তুজ আলীর ঠোঁটে হাসি লেগেই থাকে। তিনি স্বপ্ন দেখেন, এবার সব ঋণ তার পরিশোধ হয়ে যাবে। ভালোই চলবে সংসার। সামনেই বাদলাদিন। ঘরটাও মেরামত করা প্রয়োজন। তাই রোজ সকাল কাস্তে হাতে নিয়ে তিনি ছুটে যান মাঠে। খেতের আগাছা পরিষ্কার করেন। সরিষার গাছগুলো দেখে মর্তুজ আলীর পরানটা শীতল হয়ে আসে। হঠাৎ একদিন পরিযায়ী পাখির মতো কয়েকজন তরুণী শহর থেকে কমলপুর আসেন আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে। সরিষাখেতের মনভোলানো সৌন্দর্য দেখে তারা বিভিন্ন স্টাইলে নিজেদের ছবি তোলেন। তারপর সেই ছবিগুলো তারা ফেসবুকে পোস্ট করেন। সেই ছবিগুলো হু হু করে ভাইরাল হয়ে যায়। তার পর থেকে পিঁপড়ার মতো দলে দলে মানুষ আসতে থাকে দেবীপুর গ্রামে। দর্শনার্থীরা আসেন সরিষাখেত দেখার জন্য। দারুণ কিছু ছবি তোলার জন্য!
গতকালও কমলপুরে হাজার হাজার মানুষ এসেছিল। সরিষাখেতে ছবি তুলেছে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে ঠিক মাগরিবের আগে আগে। এই সময়ে নাকি ভূতেরাও নড়েচড়ে বসে। বাতাসে বাতাসে তখন ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যার ঠিক আগে মানুষের চাপ খুব কম ছিল। তিন-চারজন তরুণ-তরুণী ছিলেন। তারা মর্তুজ আলীর প্রথম প্লটে ছবি তুলছিলেন। তাদের মধ্যে একজন নাকি ফেসবুক লাইভে সংযুক্ত ছিলেন। ঠিক তখনই ভূতের ঘটনাটা ঘটে। ইয়া বিশাল এক ভূত সরিষাখেতের একদম মাঝখানে দুই পাশে দুই পা চেগিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। প্রায় ২৩ সেকেন্ড সময়। ভূতের কপাল বরাবর একটা বিশাল চোখ থেকে লাল আলো ঠিকরে বের হচ্ছিল। সেই আলো রক্তের মতো লাল। দেখে মনে হচ্ছে, যেন ভূতটা রাগে গরগর করছে। হঠাৎ বিকট শব্দে হাসতে থাকে ভূতটা। বিদঘুটে সেই হাসি শুনে যে যার মতো প্রাণটা হাতে নিয়ে দিল দৌড়। তার পর থেকেই সেই তিনজন দর্শনার্থী হাসপাতালে ভর্তি। তাদের মধ্যে দুজনের জ্ঞান ফিরেছে। একজনের জ্ঞান এখনো ফেরেনি!
পরদিন সকাল সকাল মর্তুজ আলী ঘুম থেকে ওঠেন। তার চোখেমুখে তুমুল খুশির ঝিলিক। শর্ষেখেতে ভূতের লঙ্কাকাণ্ড দেখে যখন সবাই অজ্ঞান হওয়ার মতো উপক্রম, তখনো মর্তুজ আলী হাসছিলেন! অদ্ভুত সেই হাসি ঢেউ তুলেছিল তার ভাঙা ঘরটায়! তার বউও তার সাথে সেই হাসিতে শরিক হয়েছিলেন। মানুষটা আসলেই একটা পাগল! মর্তুজ আলী বারবার টাকাগুলো গুনছেন। হ্যাঁ, তিন শ নব্বই টাকাই আছে। টাকাগুলো তিনি লুঙ্গির কোঁচড়ে গুঁজে গঞ্জের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। তাকে সুজন সাউন্ডের দোকানে যেতে হবে। গতকালের কিছু টাকা বকেয়া ছিল তার। সেই টাকা পরিশোধ করতে যাচ্ছেন তিনি।