লাল–সবুজের পতাকা হাতে নাজমুন নাহার

নাজমুন নাহার ১৪৪ দেশ ভ্রমণের ঐতিহাসিক রেকর্ড অর্জন করেন মালদ্বীপে
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের পতাকা হাতে নাজমুন নাহার ১৪৪ দেশ ভ্রমণের ঐতিহাসিক রেকর্ড অর্জন করেন মালদ্বীপে। নাজমুন নাহার বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে বিশ্বভ্রমণের ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন অচিরেই। পৃথিবীর প্রতিটি দেশে বাংলাদেশের লাল-সবুজকে তুলে ধরতে চান তিনি।

নাজমুন নাহার নিজের ঘর ছেড়ে পৃথিবীকে ঘর বানিয়েছেন। সব বাধা অতিক্রম করে দুর্বার গতিতে ছুটে চলছেন পৃথিবীর পথে পথে। এবারের করোনাকালীন পৃথিবী অভিযাত্রায়ও যার পেছনে ছিল ব্যাকপ্যাক, মুখে মাস্ক, হৃদয়ে বাংলাদেশ, হাতে লাল–সবুজের পতাকা।

২০০০ সালে প্রথম ভারত ভ্রমণ দিয়ে শুরু হয় তাঁর পৃথিবী ভ্রমণ
ছবি: সংগৃহীত

নাজমুন নাহার পৃথিবীর বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ও উপাধি পেয়েছেন তিনি।

২০০০ সালে প্রথম ভারত ভ্রমণ দিয়ে শুরু হয় তাঁর পৃথিবী ভ্রমণ অভিযাত্রা। ২০ বছর তিনি পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে চলেছেন বাংলাদেশের পতাকাকে বিশ্বদরবারে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। ১৪৪ দেশের মধ্যে ১৪টি দেশ ভ্রমণে সঙ্গী ছিলেন তাঁর মা। বাকি দেশগুলো তিনি একাই ভ্রমণ করেছেন।

আফ্রিকার আইভরি কোস্টে
ছবি: সংগৃহীত

নাজমুন নাহার পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ ভ্রমণ করেছেন সড়কপথে। প্রতিটি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দেখার জন্য এবং কম খরচে পৃথিবী ঘোরার জন্য তিনি সড়কপথে ভ্রমণের পন্থা বেছে নিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ম্যাপের ওপর গবেষণা করতেন, কীভাবে কম খরচে ভ্রমণ করা যায়।

নাজমুন শুধু কোনো একটি দেশের শহর ঘুরে ফিরে আসেননি। তিনি উঠেছেন পেরুর রেইনবো সামিটের মতো পৃথিবীর বহু পর্বত সামিটে। যেখানে প্রচণ্ড আল্টিচুডের কারণে মৃত্যুমুখে পড়েও ফিরে এসেছেন। চিলির আতাকামা, যেখানে ১০০ বছরে বৃষ্টি হয়নি, এমন আশ্চর্যজনক জায়গাতেও পা পড়েছে নাজমুন নাহারের।

চিলির মুন ভ্যালিতে
ছবি: সংগৃহীত

অনেক দ্বীপে রাতের অন্ধকারে তিনি হারিয়ে গেছেন। আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ২৬ ঘণ্টা জঙ্গলে আটকা পড়েছেন রাতের অন্ধকারে। জর্জিয়ার সনেটি প্রদেশ যাওয়ার সময় পথে গুলির মুখোমুখি হয়ে পাহাড়ে বুক বিছিয়ে চার ঘণ্টা শুয়েছিলেন। সাহারা মরুভূমিতে ভয়ংকর মরুঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন। গুয়াতেমালায় ছিনতাইকারীর গুলি আর চুরির মুখোমুখি হয়েও ফিরে এসেছেন কৌশলে।

তিনি কিরগিস্তানের আলা আরচা পর্বত সামিটে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে ছোট্ট একটা বুনো গাছের সঙ্গে ঝুলে ছিলেন। উঁচু পর্বত থেকে ঝুলে যাওয়া শরীরের নিচে ছিল গহিন ফাঁকা, যেখানে বাঁচার কোনো উপায় ছিল না। সহ–অভিযাত্রীদের সহযোগিতায় সে যাত্রায় তিনি বেঁচে ফিরেছেন।

বাংলাদেশের পতাকা হাতে ভিনদেশি পর্যটকদের সঙ্গে সার্বিয়ায়
ছবি: সংগৃহীত

ইথিওপিয়ার জঙ্গলে হামার আদিবাসীদের সঙ্গে গরুর কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে নাজমুনকে। আফ্রিকাতে তিন মাস আলু খেয়ে ছিলেন। সর্বোচ্চ আড়াই দিন না খেয়ে থাকার রেকর্ড আছে তাঁর। পথে গাছ থেকে গাছের সাদা অরেঞ্জ খেয়ে দুই দিন পর আফ্রিকাতে পানির পিপাসা মিটিয়েছেন।

দিনের পর দিন সর্বোচ্চ টানা ৫৮ ঘণ্টা, কখনো ৪৮ ঘণ্টা, কখনো ৩৬ ঘণ্টা তাঁকে বাসে জার্নি করতে হয়েছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। টানা কখনো ১৫ দেশ, কখনো ১৪ দেশ তিনি তিন মাস, চার মাস, পাঁচ মাসের জন্য সড়কপথে এক শহর থেকে আরেক শহরে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করেছেন।

পিরামিডের দেশ মিসরে
ছবি: সংগৃহীত

খরচের বিষয়ে নাজমুন বরাবরই খুব স্পষ্টবাদী। তিনি সুইডেনে পড়াশোনা করতে গিয়েছেন ২০০৬ সালে। পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করতেন। সামারে তিনি ১৭–১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করে পয়সা জমাতেন শুধু ভ্রমণ করার জন্য। কম খরচে থাকতেন পৃথিবীর বিভিন্ন ট্রাভেলার্স হোস্টেলে। কখনো তাঁবু করে, কখনো কোচ সার্ফিংয়ের মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত তিনি নিজের যোগ্যতায় নিজের শক্তিতেই পৃথিবীর এতগুলো দেশ ভ্রমণ করেছেন।

কলম্বিয়ার রক অব গুয়াতাপে
ছবি: সংগৃহীত

মানুষের যখন স্বপ্ন, ইচ্ছে, একাগ্রতা, চেষ্টা থাকে, আর সেই মানুষ যদি পরিশ্রমী হয়, তাহলে তাঁকে কেউ আটকাতে পারে না। পৃথিবীর পথ তাঁকে পথ চিনিয়েছে। হাজারো অজানা জনপদ পৃথিবীর আনাচ-কানাচের জীবন থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। অনেক সময় বর্ডার ক্রস করতে না পেরে তাঁকে স্থানীয় অপরিচিত পরিবারের সঙ্গে থাকতে হয়েছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে, তিনি জানতেন না এক ঘণ্টা পরে তাঁর জীবনে আসলে কী ঘটবে। এভাবেই তাঁকে পৃথিবী ভ্রমণ করতে হয়েছে। তবে বিপৎসংকুল পথে তিনি সব সময় কৌশলী ছিলেন।

জর্জিয়ার কাজবেগি ককেশাস পর্বতমালায়
ছবি: সংগৃহীত

নাজমুন নাহার আমাদের লাল–সবুজের পতাকার তারকা। আমাদের এক উজ্জ্বল মুখ। যুগে যুগে নারীরা বাধা ডিঙিয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমাদেরকে আলো দেখিয়েছেন। পথ দেখিয়েছেন বেগম রোকেয়া, প্রীতিলতার মতো নক্ষত্র মানুষ। নাজমুন আজ এ প্রজন্মের নক্ষত্র মানুষ হয়ে উঠেছেন আগামী প্রজন্মের জন্য। আমরা অভিবাদন জানাই আমাদের নাজমুন নাহারকে। বাংলাদেশের পতাকা যেন বিশ্বভ্রমণের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উচ্চতায় স্থান পায় নাজমুনের হাত ধরে।

নাজমুন নাহার আমাদের লাল–সবুজের পতাকার তারকা
ছবি: সংগৃহীত