লালরঙা জার্সি

অলংকরণ: তুলি

মাহিন ভাই তখন কলেজে পড়তেন, ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। মেধাবী ছাত্র। সব সময় একটা লাল জার্সি পরে খেলতে যেতেন। উনাকে খেলার মাঠেই পাওয়া যেত। ঘামে ভেজা লাল রঙের জার্সি দেখতাম বারান্দায় ঝুলত। তখন আমরা তিনতলায় ছিলাম আর উনি পাঁচতলায় থাকতেন। সারাক্ষণ তারে ঝুলে থাকত জার্সিটা।
শীতকালে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কাটার সময় মাহিন ভাইকে দেখতাম সবকিছুর তদারক করছেন। সবার থেকে চাঁদা তুলতেন, কোর্টও কাটতেন নিজে। তাঁর এক বন্ধু ছিল রিমন ভাই। তিনি সারা দিন পড়াশোনা করতেন। বিজ্ঞানী বলে ডাকত সবাই। পড়াশোনার ফাঁকে টুলবক্স নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতেন। দুই বন্ধু যেন ভিন্ন দুটি গ্রহের বাসিন্দা।
মাহিন ভাই ঘুরতে পছন্দ করতেন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, এখানে–ওখানে যাওয়া, এভাবেই তাঁর সময় কেটে যাচ্ছিল। ডিসেম্বর মাস। এইচএসসি পরীক্ষা এসে গেল। মাহিন ভাই নির্বিকার। এখনো ঘোরাফেরা করছেন, ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কাটছেন, ক্রিকেট খেলছেন। আমি একটু অবাকই হলাম। ভেবেছিলাম পরীক্ষার আগে পড়াশোনা করে হয়তো পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু রেজাল্ট মোটেই ভালো আসেনি। খুবই খারাপ ফল করলেন। রিমন ভাই গোল্ডেন এ প্লাস, জিতু ভাই এ প্লাস পেলেন। শুধু মাহিন ভাই একা পড়ে গেলেন।

মেডিকেলে পড়ার ইচ্ছা ছিল বলে শুনেছিলাম, সেই ইচ্ছা বাদ দিতে হলো। কোচিংয়েও গেলেন না। ভার্সিটির জন্য পড়া শুরু করলেন। এবার যেন সিরিয়াস। কিছু একটা করতেই হবে, এমন ভাব। এরই মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। রিমন ভাই প্রথম চান্সেই বাজিমাত। ঢাবিতে ভালো পজিশন নিয়ে টিকে গেলেন। মাহিন ভাইয়ের পাত্তা নেই। উনি পড়ছেন তো পড়ছেনই। তাঁকে আর নিচে দেখা যায় না। খেলতেও যান না। লালরঙা জার্সিটা আর কখনো দেখিনি।
বুয়েটেও চান্স পেয়ে গেলেন রিমন ভাই। তখন থেকে মাহিন ভাইয়ের মাথাটা কেমন যেন হয়ে গেল। দেখতে দেখতে সব ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা শেষ। জিতু ভাই মেরিনে চান্স পেলেন। তাঁর অনেক বন্ধু মেডিকেলে সুযোগ পেলেন। শুধু মাহিন ভাই কোথাও চান্স পেলেন না। আগে মাঝেমধ্যে নিচে খেলতে নামতেন। পরে সেটাও বন্ধ করে দিলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন প্রাইভেটে পড়বেন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হলেন।

কোথাও চান্স না পাওয়ায় বাড়িতে কথা শুনতে হতো। সহ্য করতে না পেরে রেগে গিয়ে এটা–ওটা ছুড়তেন। কখনো গ্লাস ভাঙার আওয়াজ, ধাতুর ঝনঝন শব্দ, সঙ্গে তাঁর বিকট চিৎকার তো ছিলই। মাঝেমধ্যে কান্নার শব্দও শুনতাম। ‘ভাইয়ারে, ভাইয়া তুই চুপ কর, চুপ কর।’
একসময় যখন সব শান্ত হয়ে যেত, তখন দুটি নারীকণ্ঠের করুণ সুর শোনা যেত।
এরপর বহুদিন আর তেমন কিছু শুনিনি। মাহিন ভাই মনের সুখে বাথরুমে গলা উঁচিয়ে গান গাইতেন। আমরা শুনে হাসতাম। হঠাৎ একদিন জানতে পারি, তার লিভার সিরোসিস ধরা পড়েছে। এভাবে একদিন না–ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন।
চোখের সামনে দাপিয়ে বেড়ানো, চিৎকার, হইচই, হুল্লোড় আর অট্টহাসিতে আমাদের বাসার নিচের গলিটা মুখর করে রাখতেন মাহিন ভাই। সবই এখন অনেক মিস করি।
সেদিন মাহিন ভাইয়ের মাকে দেখলাম জিতু ভাইয়ের মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন। ‍তিনি খুব ভেঙে পড়েন। হাঁটতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিলেন। হাতের ভ্যানিটি ব্যাগটাও ফসকে যাচ্ছিল। হাত দুটি কাঁপছে।

বন্ধু, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা