লাল শাপলা

বিলজুড়ে সবুজ পাতার জমিনে ফুটে আছে অসংখ্য লাল শাপলাছবি: আনিস মাহমুদ

শাপলা তোলা নিষেধ। বড় একটা সাইনবোর্ডে লেখা। চার দিন আগে বিলেত থেকে চৌধুরী সাহেবের একমাত্র নাতনি ফেন্সি দেশে এসেছে। ওখানে সে গ্রেড ফাইভে পড়ে। ঠাসঠুস ইংলিশ বলে। ফেন্সির ফুল খুব প্রিয়। লাল শাপলা তার ভীষণ পছন্দ। কাউকে ফুল ছিঁড়তে দেখলে খুব খেপে যায়। ভাঙা বাংলায় সে দাদুকে বলেছে—পরীবিল থেকে যেন কেউ শাপলা তুলতে না পারে। তিন দিন ধরে ছগীর মিয়া পরীবিল পাহারা দিচ্ছে। কাউকে শাপলা তুলতে দেখলে তার আর রেহাই নেই। ধরে সোজা চৌধুরী সাহেবের কাছে নিয়ে যায়। আজমল চৌধুরীও বেশ কড়া লোক। সুলতানপুর গ্রামের সবশেষ জমিদারও বলা যায় তাঁকে। পরীবিলের চৌদ্দ আনার মালিক তিনি। বারো আনা খাসজমি, বাকিটা লিজ নেওয়া।

ভোর হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। বাইরে ঝুম। রাহেলা বুঝতে পারে এটাই মোক্ষম সময়। পরীবিল থেকে কিছু লাল শাপলা তুলতে পারলে মা-ঝিয়ের পেট দুটো বেঁচে যাবে। ঘরে তার অসুস্থ মা। বাবা শহরে রিকশা চালান। ছয় মাস হয়ে গেছে কোনো খোঁজ নেই। শহরফেরত কে যেন বলেছে—রাহেলার বাপ শহরে নতুন বিয়ে করে বেশ সুখে আছেন।
এসব নিয়ে ভাবে না রাহেলা। সে চুপিচুপি পরীবিলে নামে। দ্রুত কিছু লাল শাপলা তোলে। লাল শাপলা তুলতে তারও খারাপ লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই। পেটে ভাত না থাকলে কোনো সুন্দরই সুন্দর লাগে না। ক্ষুধার্ত চোখ বড়ই বিবর্ণ ও ভয়ানক!
রাহেলা ক্লাস থ্রি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। অভাবের কারণে এখন স্কুলে যায় না। প্রতিদিন পরীবিল থেকে শাপলা তোলে। আর সেই শাপলা দিয়ে মালা ও ফুলের তোড়া বানায়। সেগুলো কলেজ গেটে নিয়ে বিক্রি করে। টাকা দিয়ে কিছু চাল–আলু কিনে ঘরে ফেরে। আজও সে একমনে শাপলা তুলছে। হঠাৎ পেছন থেকে ছগীর মিয়া খপ করে রাহেলার হাত ধরে ফেলেন। মনে হয় ছগীর বড় কোনো চোর ধরেছে! রাহেলা তাঁর হাত ছাড়াতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারল না।

চৌধুরীর পায়ের কাছে এখন গুটিসুটি হয়ে বসে আছে রাহেলা। ছগীর মিয়া জোর করে বসিয়েছেন। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে সে। অনেকটা জবাই করা কবুতরের মতো।
—স্যার গো, আমারে ছাইড়া দেন। আমি বাইত যামুগা। কোনো দিন আর ফুল তুলতাম না। এই যে কানে ধইরা কইতাছি।
—রাহেলা, তুই সাইনবোর্ড দেখেছিস?
—জি।
—তুই পড়তে পারিস?
—জি, স্যার।
—তাহলে শাপলা তুললি কেন?
—হুজুর গো, আমগো ঘরে কোনো চাল নাই। গত রাইতেও আমরা খাই নাই। দুই দিন ধইরা ফুল তুলতাম পারতাছিলাম না। ছগীর কাকার চোখ বেজির চোখের মতন। তাই আজকা বৃষ্টির মধ্যে কয়ডা শাপলা তুলছিলাম। শাপলা বেইচ্চা চাইল কিনতাম।
—তুই জানিস, আমার বিলেতি নাতনি শাপলা ফুল খুব পছন্দ করে?
—জি, হুজুর। জানি।
—তারপরও তুই শাপলা চুরি করার সাহস পেয়েছিস কোথায়?
—হুজুর, শাপলা দেইখ্যা আপ্নের নাতনির চোখ জুড়ায়। আর শাপলা তুইল্ল্যা আমাগোর পেট ভরে।
আজমল চৌধুরী রাহেলার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। রাহেলার শেষ কথাটা তার মাথায় ভনভন করছে। জীবন নিজেই একটা পাঠশালা। কী অদ্ভুত! সেই পাঠশালার তুখোড় মেধাবী ছাত্রী রাহেলা। চৌধুরী ছগীরকে নির্দেশ দিলেন, কিছু চাল–ডাল রাহেলাদের ঘরে দিয়ে আসতে। আর শাস্তি হিসেবে রাহেলাকে হুকুম দিলেন তাঁর নাতনি ফেন্সিকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। পরীবিল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। জীবন শেখানোর জন্য। পরীবিল লাল শাপলায় ভরে গেছে। অসাধারণ দৃশ্য। ফেন্সি মুগ্ধ নয়নে দেখছে লাল শাপলার সায়র। আর ক্ষুধা পেটে চেপে রাহেলা শাপলা তোলার পরের দিনের কৌশল ঠিক করছে।

মাধবপুর, হবিগঞ্জ