লাল বাসের প্রেম

অলংকরণ: তুলি

ফাগুনের আগমনী গান গাইছে কোকিল। গাছে গাছে ফুটছে পলাশ, শিমুল ও কৃষ্ণচূড়া। মলচত্বরে যেন কৃষ্ণচূড়া ফুলের কার্পেট বিছানো হয়েছে। লাল–হলুদ কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো মাড়িয়ে হাঁটতে বেশ ভালো লাগে রিন্তির। রিন্তি অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা এক সংগ্রামী মেয়ের নাম। তার বাবা মারা গেছেন রিন্তির সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়। তারপর মায়ের সঙ্গে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এত দূর আসতে পেরেছে সে। জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে রিন্তি সামনাসামনি দেখেছে। দাঁতে দাঁত কামড়ে লড়াই করেছে, এখনো করছেন। দেখতে সে কাশফুলের মতো নরম ও শুভ্র। ডাগর ডাগর চোখে কাজল পরলে আর কিছু লাগে না! মনে হয় সৃষ্টিকর্তা তার চোখে সবটুকু মায়া ঢেলে দিয়েছেন। যে একবার সেই চোখের অতলে ডুব দেবে, সে নির্ঘাত হারিয়ে যাবে। রিন্তি অনেকটা তরঙ্গহীন নদীর মতো শান্ত। অথচ বুকের গহীনে তার জলভাঙার শব্দ। সেই শব্দ কারও কান পর্যন্ত পৌঁছে না। অব্যক্ত কথাগুলো সে গোপন রাখতেই ভালোবাসে। নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে রিন্তি।

রিন্তি দ্রুত পায়ে হাঁটছে ক্ষণিকা বাসের দিকে। লাল বাস। দেখলেই অদ্ভুত এক পুলক সঞ্চারিত হয় তার মনে। রামিসা বাসের জানালা দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে আছে। রিন্তির জন্য। তারা দুজন সেইরকম বান্ধবী। হরিহর আত্মার বন্ধু। ক্যাম্পাসে তারা দুই মেরুতে পড়াশোনা করে। অথচ এই লাল বাসের কারণেই তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। রিন্তি টিউশনির জন্য লাল বাসে ওঠে। বাসে করে টিউশনিতে গেলে মাসে তার কয়েকটা টাকা বেঁচে যায়। এই লাল বাসে করে যাওয়ার পথেই দুজনের পাশাপাশি বসা, পরিচয় ও গল্প। তারপর বন্ধুত্ব। গত দুমাস হলো রিন্তি রামিসার ছোট ভাইকে পড়াচ্ছে। খুব ভালো পড়ায় সে। অর্থনীতির ছাত্রী হলেও গণিত ও ইংরেজিতে বেশ দক্ষ সে। আর এখন তো রিন্তিও রামিসার পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে। রামিসার মা তাকে মেয়ের মতোই দেখেন। এটা–ওটা করে রাখেন তার জন্য।

ক্ষণিকা বাস মানে তারুণ্যের আঁতুড়ঘর। এই রুটে সেইরকম ভিড় হয়। বাদুরঝোলা হয়ে কেউ কেউ ঘরে ফেরে। কেউ একজন বাসে বসে গিটারে সুর তুললে বাকিরাও তাল ধরে। একই সুরে গান গায়। এই গান ভুলিয়ে দেয় ঢাকা শহরের বিরক্তিকর যানজটকে। জুনিয়র কোনো সুন্দরী মেয়েকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার সুচতুর কৌশল থাকে সিনিয়র ভাইদের। কেউ কেউ চে গুয়েভারার ছবিওয়ালা টি-শার্ট পরে বিপ্লবীর ভাব নেয়! কবি কবি ভাব ধরে দু–একজন। চারুকলার ছেলেটা সব সময় খুব এলোমেলো থাকে, যেন হবু এস এম সুলতান। অদ্ভুত সব চরিত্রগুলো বুকে নিয়ে ছুটে চলে লাল বাসটি। ঢাকা শহরের রাস্তায় বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়ায়। বিষয়টা ভালোই লাগে রিন্তির। বাসের চারপাশে সে চোখ ঘুরিয়ে দেখে। কোনো কোনো কপোত-কপোতী হয়তো চোখে চোখ রেখে অনেক না বলা কথা বলছে। শব্দহীন। পাশাপাশি বসে দিনের ইতিবৃত্ত বর্ণনা করছে কেউ কেউ। বিষয়বস্তু অবশ্য ক্লাস, সহপাঠী, প্রেম–ভালোবাসা অথবা দেশ ও বৈশ্বিক রাজনীতি।

একটা বিষয় রিন্তি গত চার দিন ধরে খেয়াল করছে। একটা ছেলে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটার চোখে চোখ পড়তেই আলগোছে সে চোখ সরিয়ে নেয়। যেন মায়ায় ধরা না পড়ার দুর্দান্ত লুকোচুরি খেলা! ব্যাপারটা ভীষণ বিব্রতকর। তবুও বেশ ভালো লাগছে রিন্তির। রিন্তিও যেন চাচ্ছে ছেলেটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকুক। ছেলেটা চোখের মায়াজালে বন্দী হোক। জ্বলুক, পুড়ুক। অনন্তকাল ধরে চলুক এই চোখাচোখির খেলা। লুকোচুরি। অথচ রিন্তি কিন্তু এমন নয়। সে খুব অঙ্ক কষে চলে। প্রতিটা পা ফেলে ক্যালকুলেটর টিপে। অথচ সেই কিনা বেহিসাবির মতো এসব করছে! তাহলে কি ছেলেটার মায়ায় পড়ে গেছে সে? ধ্যাৎ! এসব উড়াল ভাবনা কেন যে মাথায় আসে? এমন একটা অভিব্যক্তি চোখেমুখে এনে নিজের মাথায় নিজের হাতেই থাপ্পড় মারে সে। বিষয়টা মনে হয় রামিসা এখনো টের পায়নি। বুঝতে পারলে সে রিন্তিকে দারুণভাবে পচাবে। ক্যাম্পাসে তাকে তামাদি করে দেবে। তাই ভয়ে ভয়ে সে রামিসাকে নিজ থেকে কিছুই বলছে না। গোপনে একা একা উপভোগ করছে।

ছেলেটাকে দেখলে বুদ্ধিজীবী গোছের মনে হয়। কথা কম বলে হয়তো। সারাক্ষণ বই পড়ে। দুই হাতে বইটা ধরে নাক ডুবিয়ে পড়ে সে। সে বাসে থাকা অবস্থায় মুঠোফোন চালায় না। বোঝা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছেলেটা বেশ অনিয়মিত। এসব হচ্ছেটা কী! রিন্তির মগজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাচ্ছে ছেলেটা! রিন্তি চাচ্ছে না। আবার চাচ্ছেও। এভাবে প্রায় একুশ দিন চলে গেল। তারা দুজনই গোপনে গোপনে চোখাচোখি করে। ইদানীং চোখে চোখ পড়লে দুজনই হাসে। সে হাসি ছড়িয়ে যায় রক্তের শিরা–উপশিরায়। দারুণ এক অনুভূতি মুহূর্তেই খেলা করে শরীরে শরীরে।

দীর্ঘ আঠারো মাস পরে ক্যাম্পাস আবার খুলেছে। মরণঘাতী করোনার থাবার কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ ছিল। পাঁচ দিন ধরে আবার সেই লাল বাস ক্ষণিকা চলাচল শুরু করেছে। রিন্তির মনটা আজ ভীষণ খারাপ। বাসের ভেতর ছেলেটাকে সে দেখছে না। ইতিউতি খুঁজছে সে। কিন্ত কোনো হদিস নেই। তার বুকের ভেতরটা যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অসহ্য সেই যন্ত্রণা। না কাউকে বলা যায়, না মনে পোষা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই কথারা ছটফট করে বুকে। আজ বাস এখনো ছাড়েনি। রিন্তি বাসের জানালা দিয়ে বাইরে মুখ বের করে ছেলেটাকে খুঁজছে। কিন্তু কোথাও তার অস্তিত্ব নেই। ছেলেটার কি পড়াশোনা শেষ? বিদেশে চলে গেছে? নাকি কোনো দুর্ঘটনা ঘটল? করোনায় কিছু হয়নি তো আবার? কত মানুষই তো করোনায় নাই হয়ে গেল। ধ্যাৎ! কেন যে ছেলেটার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি সে! এ রকম কত শত ভাবনা যে রিন্তির মাথায় জট পাকাচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই।

বাস চলছে। বাইরে শরতের ঝকঝকে আকাশ। মেঘেদের খুনসুটি চলছে। অথচ রিন্তির মনে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে মন খারাপের কালো কালো মেঘ। সেই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার পূর্বাভাস কেউ পায় না। সেই মন খারাপের কালো মেঘ কেউ দেখে না। আজই প্রথম রিন্তির শামুকীয় কৌশল কাজ করছে না। কোনোক্রমেই নিজেকে লুকাতে পারছে না সে। বিষণ্নতার এক প্রচ্ছন্ন ছায়া পড়েছে তার চোখেমুখে। প্রিয় মানুষ হারানোর ব্যথায় নীল সে আভা, ছড়িয়ে গেছে মন থেকে শরীরে; চোখেমুখে। ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’র মতো ব্যাপারটা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছে রামিসা। দুই দিন ধরে রিন্তির বিষয়টা খেয়াল করছে সে। যেহেতু রিন্তি তার সঙ্গে কিছুই শেয়ার করেনি, তাই এখন এসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো হবে, এমনটা ভেবে বিষয়টার দম ছাড়ে রামিসা। কিন্তু সে অপেক্ষা করছে রিন্তির কাছ থেকে সবকিছু শোনার জন্য।

- এই রিন্তি, কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?

- কিছু হয়নি রে।

- হয়নি বললেই হলো! কিছু একটা তো হয়েছেই।

- না, তেমন কিছু না।

- আমার কাছে লুকাচ্ছিস? গতকালও দেখলাম তুই ভীষণ মন খারাপ করে বসে আছিস। বাসের এদিক–ওদিক কী যেন খুঁজছিস? আমাকে বল...!

- না রে। তেমন কিছু না। বাবাকে বড্ড মিস করছি। খুব মনে পড়ছে তার কথা।

লাল বাসটা চলছে একই রাস্তা ধরে। রিন্তি চাচ্ছে দ্রুত বাস থেকে নেমে যেতে। নামতে পারলেই যেন সে বেঁচে যায়। আজ বাসে তার দমটা বন্ধ হয়ে আসছে। গিটারের টুংটাং শব্দ খুবই বিরক্তিকর লাগছে। ধেড়ে গলার গানগুলো মনে হচ্ছে শব্দবোমা। আজকের আড্ডাবাজি, কারও কারও প্রেম প্রেম খেলা, চোখাচোখি—সবকিছু বড্ড বিরক্তিকর মনে হচ্ছে তার। রিন্তি তার মুখটা জানালায় রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। লাল বাসটা বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। আহা! ঝুমবৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছে এই শহরের ধুলো পড়া সবুজ পাতাগুলো।

মাধবপুর, হবিগঞ্জ।