রেললাইন

প্রতীকী ফাইল ছবি
প্রথম আলো

বন্ধু রায়হান আর আমি ছুটছি। মধ্য দুপুরে, স্কুল পালিয়ে। নানুবাড়ি থেকে স্কুল আরও উত্তরে। গ্রাম আর আমন ধানের ছোট্ট একটি মাঠ পেরিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আজ আমরা ছুটছি ট্রেনলাইন বরাবর পশ্চিমে। শীত চলে যাচ্ছে। বসন্তে চারদিকে প্রকৃতির জেগে ওঠার সব সবুজ আয়োজন চলছে পুরোদমে। গরমের আভাসও স্পষ্ট। বছরের প্রথমদিকে বলে পাঠদান ভালো করে জমে ওঠেনি, ঢিলেঢালাভাবে চলছে। আমরা স্কুল পালিয়েছি টিফিন পিরিয়ডের পরই। ভারি সুন্দর এক জায়গায় আমাদের স্কুলটি। কাছেই মায়াবতী নদী সুরমা। সুরমার একটি ছোট্ট শাখা নদী বয়ে গেছে মরমি কবি হাসন রাজার স্মৃতিধন্য রাজাগঞ্জ বাজার হয়ে ভাটির দিকে। স্কুলের পাশেই সেই নদীর ওপর লোহার ছাউনিসমেত একটি লাল ব্রিজ। স্কুলের প্রবেশপথেই ছোট্ট একটি পাকুড় গাছ। আর স্কুল প্রাঙ্গণে আছে দুই–তিনটি বয়েসি রেইনট্রি। পূর্বে নদী। দক্ষিণে রেললাইন। আর বাকি দুই দিকে খোলা মাঠ। আশপাশে বাড়িঘর নেই। গ্রামগুলো একটু দূরে। আজ স্কুল পালানোর সময় স্কুলের দিকে বিশেষ করে চোখ পড়ল। প্রতিদিন যা দেখে অভ্যস্ত চোখ, সে চোখে সবকিছু নজর কাড়ে না। হঠাৎ একদিন আলাদা করে দেখলেই কেবল তার সৌন্দর্য চোখে পড়ে।

স্কুল পালিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটি দুষ্ট বুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলে গেল। রেললাইনে যে বড় বড় ক্লিপ পিন দিয়ে কাঠের স্লিপারগুলোর সঙ্গে লোহার লাইন আটকে রাখা হয়, সেগুলো অনেক জায়গায় ঢিলা হয়ে আছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে খুঁজতে শুরু করলাম। কিছু দূর পরপর একটা ঢিলা পিন পেয়ে যাচ্ছিলাম। সংগ্রহ করতে শুরু করলাম। এগুলো দেখতে ছোট ছোট হাতুড়ির মতো। হাতুড়ির কাজ সারে। আহামরি প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমরা কৌতূহলে সংগ্রহ করে চলেছি। বেশ কটা সংগ্রহের পর আমাদের পকেটগুলো ভরে উঠল। হাতেও কটা নিলাম। তারপর প্রীতিগঞ্জ বাজারের পাশে থাকা রায়হানের এক আত্মীয়ের বাসায় দুপুরের বিলম্বিত খাবার খেয়ে বাঁশবনের ছায়াঢাকা নির্জন গ্রামের মেঠোপথ পেরিয়ে মাঠে নামলাম। বিকেল হয়ে আসছে। এবার ফেরার পালা।

কিছুদিন পর ছিল আমাদের গ্রীষ্মের ছুটি। ছুটিতে মা, ছোট্ট দুই ভাইসহ শহরে মামার বাসায় ঘুরতে যাচ্ছিলাম ট্রেনে করে। বাড়ি থেকে অনতিদূরে স্টেশন। ট্রেন যখন আসে, স্টেশনগুলো হঠাৎ জেগে ওঠে। চাঞ্চল্য বেড়ে যায়। যেন শত–সহস্র মানুষের জীবনের কলধ্বনিতে মুখর অঙ্গন। কত মানুষ নামে। তারপর নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে হারিয়ে যায়। স্টেশন তার আত্মকথা লিখতে পারলে হয়তো জানতাম, এখানে কত বিচিত্র মানুষ জীবনের কত শত বিচিত্র গল্প নিয়ে হাজির হয়।

হঠাৎ ট্রেনের চেনা সেই হুইসেল শোনা গেল। ট্রেন নিকটবর্তী। সবাই ব্যাগ-বোঁচকা হাতে নিচ্ছে। সতর্ক হয়ে উঠছে যাত্রীরা। যেন মুহূর্তের অসতর্কতায় মিস হয়ে যেতে পারে ট্রেন। অজানা এক উৎকণ্ঠা ভর করে সবার মনে। স্টেশনে সময়মতো পৌঁছাতে না পারার জন্য তো অনেকের ট্রেন মিস হয়ে যায়। একবার মিস হওয়া মানে এই দিন আবার বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করা। আবার দুর্ভাগা হলে কখনো কোনো গোলযোগে ট্রেন আসেই না। মানুষের জীবনও এমন এক জার্নি। অনেক কিছু পলকের অসতর্কতায় মিস হয়ে যায়। যার মিস হয়, সে গন্তব্য থেকে অনেক দূরে বসে থাকে, এই ফাঁকে সহযাত্রী কেউ চলে যায় অনেক দূর। ভাবতে ভাবতেই আমাদের নাকের ডগায় ট্রেন এসে দাঁড়ায়। হুড়োহুড়ি করে সবাই উঠছে। একটু পরই ফের হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছুটতে শুরু করল। কী মনোরম সুন্দর চারদিক! গ্রাম-বাংলার সবুজ প্রকৃতি যেন হাতছানি দিয়ে অবিরাম ডাকছে। এই সুন্দর মাঠ–ঘাট পেরিয়ে বীরদর্পে যেন ছুটে চলেছে এক মস্ত দানব। হকাররা এটা সেটা নিয়ে উঠে কামরায় যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। এক অন্ধ ফকির করুণ সুরে গান গাইতে গাইতে ভিক্ষে করছে। মাঠে মাঠে সবুজ ধান। জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকছে বাতাসের শোঁ শোঁ ঝাপটা। হঠাৎ শোনা গেল ট্রেন মাঠ পেরিয়ে যাবার সময়ই হঠাৎ কুই কুই করে থেমে যাচ্ছে। দূরে একটি ছেলে লাল একটা কাপড় উড়িয়ে ছুটছিল। ট্রেন থামার পর আমরা জানলাম কিছু দূরেই নাকি রেললাইন খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। কিশোরের উপস্থিত বুদ্ধির জোরে সবাই বড় ধরনের নিশ্চিত বিপদ থেকে বেঁচে গেছে।

না হলে ট্রেন হয়তো এতক্ষণে লাইনচ্যুত হয়ে যেত। আমরাও বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতাম। তখন আমার সহপাঠী রায়হানের কথা খুব মনে পড়ছিল। আর মনে পড়ছিল সেদিনের কথা। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমাদের মতো কেউ হয়তো এমন কাণ্ড করেছে। তাই ট্রেন চলার পর কোনো একসময় লাইন সরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। সেবার শহরে ছুটি কাটিয়ে ফিরেই বন্ধু রায়হানকে সব খুলে বললাম। এমন বিপদ থেকে সেদিন বেঁচে গেছি আমরা বড় কপালগুণে। ওই ক্লিপ পিনগুলো আমরা বাড়িতে এক জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলাম। একদিন স্কুল ছুটির পর খুঁজে খুঁজে যেসব জায়গায় মিসিং ছিল, সেখানে একটি বড় হাতুড়ি দিয়ে সেগুলো সেঁটে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমরা একদিন চুপিসারে বের হলাম। গিয়ে দেখি কর্তৃপক্ষ নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে ইতিমধ্যেই নতুন ক্লিপ লাগিয়েছে। আমরা শপথ করলাম, কোনো দিন এমন কাজ করবে না। যে কাজে পরের অনিষ্ট হয়, সেটা একদিন নিজের জন্যও কাল হতে পারে।