রাতের শেষ জার্নি দুজনে

অলংকরণ: তুলি

সেদিন ছিল মেঘলা আকাশ। দুপুর বেলা একপশলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে। কদিন ধরে ভাবছিলাম ওকে মা–বাবার সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে যাব। কঠিন রোগটি ধরা পড়ার পর থেকে যাওয়া হয়নি আজ অবধি। আমার ব্যস্ততার কথা ভেবে আমাকে বলতে পারেনি কখনো বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা। এত বড় একটা অসুখ হওয়ার পর থেকে আজও একবারের জন্য মা–বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি। না জানি মনে মনে কত কথা মনে পড়ে। এমনিতেই মেয়েরা মা–বাবার প্রতি একটু দুর্বল থাকে, তারপর মরণব্যাধিতে যাকে ধরেছে...!

সেদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েই ফিরেছি। বললাম, ব্যাগ গোছাও চল ঘুরে আসি। গন্তব্যের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, তুমি কি ছুটি নিয়ে এসেছ? বললাম, হ্যাঁ।
বলল, এখন এই সময়ে তুমি কীভাবে যাবে?
বললাম, রাতের ট্রেনে।

ট্রেন সেই রাত ১০টায়, হাতে অনেক সময়। চোখেমুখে আনন্দের ঝলক দেখেছিলাম সেদিন, আর দ্বিমত করল না, রাজি হয়ে গেল। কত দিন পর, মা–বাবাকে দেখতে যাবে, কল্পনায় ভেসে ভেসে মনের মাধুরী দিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত এটা–সেটা করে ব্যাগ গোছাল। সংসারের সব জিনিসপত্র গোজগাছ করে রাখল।
সন্ধ্যার পর যথাসময়ে রওনা হলাম।

প্রায় ১৫ মাইল দূরত্বে রেলস্টেশন, তাই আগেভাগেই রওনা দিতে হলো। সেদিনের স্মৃতি বড় বেশি মনে পড়ে। সেদিন দেখে ছিলাম তার কৃতজ্ঞতাবোধ, ছিলাম তার কাছে আমি পৃথিবীর এক সেরা মানুষ। তার ভালোবাসা, ভক্তি-শ্রদ্ধাও ছিল ভিন্ন।

রাত ৮টার বাসে রওনা দিলাম স্টেশনের উদ্দেশে রাত ৯টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম। তখন হালকা হালকা বৃষ্টি পড়ছে, বাস থেকে নেমে রিকশা করে যথাসময়ে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। তখনো ট্রেন আসতে বেশ দেরি, রাত ১০টায় ট্রেন। স্টেশনে একটি ফাঁকা বেঞ্চ পেয়ে দুজনে বসে রইলাম। আবহাওয়াটা বেশ ঠান্ডা ছিল, চায়ের প্রতি একটু দুর্বল হয়ে পড়ে ছিলাম; কিন্তু ওকে একা রেখে যেতে মন চাইছিল না। আবার তারও আমাকে ছাড়া একা বসে থাকতে মন চাইছিল না। কারও ইচ্ছা বা স্বাধীনতার ওপর কোনোরকম বাধা দিতে পারত না, অনেক নরম মনের মানুষ ছিল। অনুমতি নিয়ে অতি কাছেই একটি চায়ের দোকানে চা খেতে গেলাম, চায়ে চুমুক দিতেই ফোন বেজে উঠল, ফোন ধরতেই মায়াবী কণ্ঠে কানে ভেসে এল, এত দেরি হচ্ছে কেন! তাড়াতাড়ি এসো! অর্ধেক চা রেখে সঙ্গে ট্রেনের টিকিট কেটে নিয়ে দ্রুত ফিরে এলাম।

অনেক সময় নীরবে পাশাপাশি বসে রইলাম, বুঝতে পারছিলাম মনে মনে কত কিছু ভাবছে, তাই আর আমিও তার কল্পনার রাজ্যে প্রবেশ করিনি। আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা, জল সিঞ্চনে ভেজা বুনো বাতাস গায়ের ওপর আছড়ে পড়ছিল। এর মধ্য ট্রেনের ঘণ্টা বেজে উঠল, ট্রেনে ওঠার জন্য জায়গামতো দাঁড়িয়ে গেলাম। অসুস্থতার কারণে আগেই জেনে নিয়ে ছিলাম কোন বগি কোথায় থামবে। ট্রেন এল, ট্রেনে উঠে অতি সহজেই নিজেদের আসন খুঁজে নিয়ে বসলাম। জানালার পাশেই সিট ছিল। যথাসময়ে হর্ন বাজিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল, ধীরে ধীরে ট্রেন চলতে আরম্ভ করল। ট্রেন ছুটে চলেছে আপনগতিতে।

মনে পড়ছে নানা কথা নানা স্মৃতি। চেনাজানা অনেক জায়গা অতিক্রম করে ট্রেন এগিয়ে চলেছে। ছেলে দুটি জানালার পাশে বসার জন্য দুই ভাইয়ে কত ঠেলাঠেলি করত, রাতের বেলায়ও বায়নার কমতি হতো না, কত কিছু খেতে চাইত, কতবার ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও নামতে হতো। আজ বাচ্চারা অনেক বড় হয়েছে। সেদিনগুলো আজ অতীত হয়েছে—আজ শুধু আমরা দুজন।
রাতের নীরবতা ভেঙে অন্ধকারের বুক চিরে খোলা প্রান্তর দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে চলেছে ট্রেন।
রাতের আঁধারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না, শুধু পাশের গ্রামের রাতের উজ্জ্বলহীন আলো পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলেছি।

বাইরে থেকে হালকা বৃষ্টি মেশানো ঝাপটা বাতাস আছড়ে পড়ছিল জানালা দিয়ে। আমরা দুজন পাশাপাশি। ইতিমধ্যে অনেক চেনাজানা স্টেশন পেছনে ফেলে এসেছি, যখন আপন গন্তব্যে উল্লাপাড়া স্টেশনে পৌঁছে গেলাম, তখন রাত তিনটা বাজে। অপেক্ষার শেষে আমরা ট্রেন থেকে নেমে একটা চা স্টলের সামনের বেঞ্চে বসলাম। বারবার বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম কখন ভোর হয়। অপেক্ষার প্রহর বুঝি আর শেষ হয় না। ক্লান্তি কাটাতে এক কাপ চা খেয়ে নিলাম। রাতের স্টেশনে প্রায় সারা রাত চায়ের স্টল খোলা থাকে। ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরা হাঁকডাক দিয়ে ফিরছে—এ্যা বাদাম—এ্যা গরম ডিম। অথচ এই রাতে পরম মমতায় মায়ের পাশে ঘুমিয়ে থাকার কথা ছিল। ভাগ্যদোষে আজ ওরা রাতের ফেরিওয়ালা।

একসময় চারদিক থেকে সুমধুর আজানের সুর কানে আসতে লাগল, একে একে সিএনজিচালিত অটোরিকশা আসা শুরু হলো। ভাড়া মিটিয়ে একটি অটোরিকশা নিয়ে রওনা হলাম। বেশ ঠান্ডা পড়ছে তার মধ্যে আবার একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। শাহাজাদপুর যখন পার হলাম তখন চারদিকে বেশ ফর্সা হয়ে গেছে। রাস্তার দুই ধারে বিস্তীণ এলাকাজুড়ে থইথই অথই জল চোখে পড়ছে, মনে হচ্ছে সমুদ্রের মাঝখান দিয়ে পিচঢালা রাস্তাটি চলে গেছে। তখনো মানুষ জেগে ওঠেনি, আসেনি প্রাতর্ভ্রমণে। হিমেল বাতাস আর চারদিকে সুনসান নীরবতা, সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। যখন যমুনার ঘাটে পৌঁছালাম, তখন শিশু সূর্যটা পূর্ব দিকে জেগে উঠেছে। ঘাটে বাজারের নৌকাও এসে জমেছে দু–একটি। চেনাজানা একটি নৌকা ঠিক করে ওর হাতটি ধরে ঘাটের উঁচু গড়ান নামিয়ে নৌকায় বসিয়ে দিলাম।

ভোরের আলোয় যমুনার বুক চিরে তরতর করে এগিয়ে চলল আমাদের নৌকাটি। সোনালি ভোরের রক্তিম আভা যমুনার জলের বুকে পড়ে এক অপরূপ মুগ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ওর মনের নীরব ব্যথাগুলো কিছুক্ষণের জন্য স্রোতস্বিনী যমুনার জলে মিশে গেছে। আমি শুধু ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। আশুমুক্তির দুয়ার খোলা ছিল না তার, তবু যেন ষোড়শী আনন্দ হিল্লোলে টলমল করছিল দুটি চোখ। যেন এক মরু তৃষ্ণা ছিল বুকে। বাবার দেশের চির চেনা প্রকৃতি, চেনা নদীর ঢেউ, চেনা মানুষের মুখ,
চির চেনা বাবার বাড়ির ঘাট...

সেদিন আমি ওর চোখে–মুখে অন্য রকম এক আবেগ অনুভূতি দেখেছিলাম। সেদিন —কে জানত! এ আসাই তার জীবনের শেষ আসা হবে...!!!
ফোন করে আর বলবে না, এত দেরি হচ্ছে কেন! তাড়াতাড়ি এসো...!!!