রহস্যময় বগা লেক পেরিয়ে কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়

রহস্যময় বগা লেক পেরিয়ে কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়
ছবি: সংগৃহীত

পাহাড়প্রেমীদের জন্য বান্দরবান এক স্বর্গরাজ্য। উঁচু-নিচু পাহাড়ের সমাবেশ বান্দরবানকে দিয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য এক মাত্রা, যা পর্যটকদের কাছে ডাকে বারবার। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে আমি ও কয়েকজন বন্ধু মিলে সম্প্রতি ঘুরে এসেছি ট্রেকিংপ্রেমীদের প্রিয় জায়গা বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বান্দরবানের কেওক্রাডং।

কেওক্রাডং বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় অবস্থিত। কেওক্রাডং শব্দটি মারমা ভাষা থেকে এসেছে। মারমা ভাষায় কেও মানে ‘পাথর’, কাড়া মানে ‘পাহাড়’ আর ডং মানে ‘সবচেয়ে উঁচু’। অর্থাৎ কেওক্রাডং মানে সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়।

কেওক্রাডং যেতে হলে আগে আপনাকে যেতে হবে বগা লেক। সেখান থেকে ট্রেক করে পৌঁছাতে হবে কেওক্রাডং। এখন সরাসরি কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় চলে যাওয়া যায় চাঁদের গাড়ি করে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বঞ্চিত হবেন ট্রেকিংয়ের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা থেকে। আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে কেওক্রাডং জয়ের যে আনন্দ, তা অন্তত চাঁদের গাড়িতে করে কেওক্রাডং যাওয়ার মধ্যে নেই।

আমরা ছিলাম ১২ জন। আগে থেকেই আমাদের চাঁদের গাড়ি ভাড়া করা ছিল। বান্দরবান শহর থেকে সকাল সকাল আমরা উঠে যাই চাঁদের গাড়িতে, উদ্দেশ্য বগা লেক। বগা লেক বান্দরবান জেলা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতায় একটি হ্রদ। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, এটি প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট একটি হ্রদ। কিন্তু এ হ্রদ নিয়ে রয়েছে অনেক রহস্য, অনেক কল্পকাহিনি।

রহস্যময় বগা লেক পেরিয়ে কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়
ছবি: সংগৃহীত

বগা লেক ঘিরে বসবাস করে ‘বম’ উপজাতির মানুষেরা। বম ভাষার শব্দ বগা অর্থ ড্রাগন। তারা বিশ্বাস করে, অনেক আগে এখানে ছোট বাচ্চাদের খেয়ে ফেলা ড্রাগন বাস করত। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে গ্রামের লোকেরা ড্রাগনকে হত্যা করলে ড্রাগনের মুখ থেকে প্রচণ্ড আগুন বের হয়ে পাহাড়কে বিস্ফোরিত করে। আর তা থেকেই জন্ম নেয় এই লেক। তা ছাড়াও এ বগা লেককে ঘিরে শোনা যায় আরও নানা গল্প।

রহস্যময় বগা লেক পেরিয়ে কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়
ছবি: সংগৃহীত

আমরা চাঁদের গাড়ি করে পৌঁছে যাই রুমাবাজার। সেখানে আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাইড আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সেখান থেকে ছাড়পত্র নিয়ে রওনা দিই বগা লেকের দিকে, রুমাবাজার থেকে যার দূরত্ব প্রায় ১৭ কিলোমিটার। দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাই বগা লেকে। বিকেলজুড়ে উপভোগ করি বগা লেকের সৌন্দর্য। রাতে আমরা থাকি বাগা লেকের পাশের একটা কটেজেই। কটেজের বারান্দা থেকে চাঁদের আলোতে বগা লেকের সৌন্দর্য যেন বেড়ে গিয়েছিল কয়েক গুণ।

পরদিন সকাল সকাল আমরা কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। কিছুটা ট্রেক করার পর আমরা পৌঁছে যাই চিংড়ি ঝরনা। পথিমধ্যে আমরা পেয়েছি ছোট ছোট অনেক অস্থায়ী দোকান, যেখানে ছোট বাচ্চারা শরবত, পেঁপে, কলা—এসব বিক্রি করছিল। যদিও পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে সে কষ্ট আমরা ভুলে যাচ্ছিলাম নিমেষেই।

রহস্যময় বগা লেক পেরিয়ে কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়
ছবি: সংগৃহীত

দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাই দার্জিলিংপাড়া। এ পাড়াকে বলা হয় বাংলাদেশের সব থেকে পরিচ্ছন্ন গ্রাম, আসলেই তাই। দার্জিলিং পাড়াতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার শুরু করি ট্রেকিং। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাই কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়।

সেখানে পৌঁছে যে দৃশ্য দেখেছি, তা নিমেষেই পাঁচ ঘণ্টার ট্রেকিংয়ের সব ক্লান্তি দূর করে দেয়। বিকেলটা আমরা কেওক্রাডংয়ের চূড়া ও হেলিপ্যাডে ঘুরে কাটাই। রাতে সেখানের কটেজেই থাকি। কটেজের বারান্দা থেকে সকালবেলার সূর্যোদয়ের দৃশ্যটা ছিল সারা জীবন মনে রাখার মতো। তারপর সকাল আটটার মধ্যেই আমরা আবার কেওক্রাডং থেকে বগা লেকের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। বাগা লেক থেকে চাঁদের গাড়ি করে পৌঁছে যাই বান্দরবান শহরে। শেষ হয় আমাদের রোমাঞ্চকর কেওক্রাডং অভিযান।

বন্ধু, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা