রবীন্দ্রনাথের সংগীতভাবনা, আইনস্টাইন সংসর্গে

১৯২৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জার্মানির বার্লিনে দেখা হয় বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ছবি: সংগৃহীত

১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন আইনস্টাইনের বাসভবনে বার্লিনের উপশহরে। তাদের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে দিয়েছিলেন দুজনেরই অভিন্ন বন্ধু ডা. মেন্ডেল। পরে আইনস্টাইন ফিরতি সফরে আসেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে, ডা. মেন্ডেলের বাড়িতে। এই দু সাক্ষাৎকারের কথোপকথন রেকর্ড করা হয়।

আইনস্টাইনের সাথে কবির প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯২৬ সালে, এ সাক্ষাৎ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

‘প্রথম মহাযুদ্ধের পর জার্মানিতে গিয়ে আইনস্টাইনের সঙ্গে আমার দেখা। মনে পড়ে আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার মান-উন্নয়নে আধুনিক যন্ত্রশিল্পের উপযোগিতা সম্পর্কে আমাদের আলাপ হয়েছিল। তখন (১৯২৬ সালে) আমি বলেছিলাম, আর আজও আমি বিশ্বাস করি, যন্ত্রবিদ্যার এই উন্নতি আসলে আমাদের শারীরিক কল্যাণ বিধানের অনুকূল-বিশেষত এই উন্নতির প্রতিরোধ যখন অসম্ভব, তখন প্রয়োজনের তাগাদায় মানুষের বিদ্যাবুদ্ধি জীবনে যে সুবিধার সৃষ্টি করেছে তার সুচিন্তিত সদ্ব্যবহার করাই তো আমাদের কর্তব্য। সভ্যতার যে স্তরে মানুষ আজ উন্নীত, তাতে যেমন আঙুলে জমি আঁচড়ে চাষ করার কথা ভাবা যায় না, তেমনি হস্তপদ জ্ঞানেন্দ্রিয় কর্মেন্দ্রিয় যেখানে পরাজিত, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি যন্ত্র সৃজন করে আমাদের অক্ষমতা ঘুচিয়ে চলেছে। আইনস্টাইন আর আমার মধ্যে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ মতের মিল হলো যে, নূতন নূতন যন্ত্রাবিষ্কারের সাহায্যে প্রকৃতির অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে আমাদের জীবনযাত্রার সম্পদ আহরণ করতে হবে।’

১৯৩০ সালের সাক্ষাৎকারে অস্তিত্ব, পরম সত্তা, পরম সত্য নিয়ে এই বিশ্বকবি ও বিশ্ববিজ্ঞানীর মধ্যে কথা হয়।

কিন্তু আরেকটা অংশে দুজনে কথা বলেছেন সংগীত বিষয়ে, বিশেষ করে প্রাচ্য সংগীত ও বাংলার সংগীত নিয়ে। এতে সংগীত বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের খুবই গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও মত উঠে আসে, যা আমাদের আজকের দিনে সামনে নিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করি।

সেই অংশটা এখানে অনুবাদ করে দিচ্ছি।

রবীন্দ্রনাথ: মানবিক ব্যাপারস্যাপারের মধ্যেও একটা স্থিতিস্থাপকতা আছে, আছে কিছু স্বাধীনতা, ক্ষুদ্র পরিসরে যা আমাদের ব্যক্তিত্বে প্রকাশিত হয়। এটা ভারতের সংগীত সিস্টেমের মতো, যা পশ্চিমা সংগীতের মতো অতটা অনড়ভাবে ধরাবাঁধা নয়। আমাদের সুরস্রষ্টারা একটা নির্দিষ্ট কাঠামোরেখা দেন, দেন সুর ও তালের একটা সুস্থিত ব্যবস্থা, এবং একটা সীমার মধ্যে থেকে বাদকেরা এটার ওপরে ইম্প্রোভাইজ করতে পারে। তাকে অবশ্যই সুরের আইন মেনে চলতে হবে, তারপর তিনি পারবেন তার নিজস্ব সাংগীতিক অনুভূতি তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করতে, নিয়ম মেনে। আমরা একজন সুরস্রষ্টার প্রশংসা করি তার প্রতিভার জন্য, তিনি সুরের যে ভিত্তি সৃষ্টি করেন, যে সৌধ রচনা করেছেন তার জন্য। কিন্তু আমরা একজন বাদকের কাছ থেকে দক্ষতা চাই যার দ্বারা তিনি সৃষ্টি করতে পারবেন সাংগীতিক বৈচিত্র্য, ভেরিয়েশন, যা কিনা সুরের সমৃদ্ধি ও অলংকরণ ঘটাবে। সৃজনশীল কাজে আমরা অস্তিত্বের কেন্দ্রীয় নিয়ম মেনে চলি, আমরা নিজেদের (কেন্দ্রীয় নিয়ম থেকে) কেটে ফেলে বেনো জলে ভেসে চলি না, কিন্তু আমরা আমাদের ব্যক্তিত্বের সীমার মধ্যে থেকে আত্মপ্রকাশের জন্য স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি।

আইনস্টাইন: এটা সম্ভবপর সেখানে, যেখানে সংগীতের একটা শক্তিশালী শৈল্পিক ঐতিহ্য বিদ্যমান, যা মানুষের মনকে পথ দেখাবে। ইউরোপে সংগীত জনপ্রিয় শিল্প ও জনপ্রিয় অনুভূতি থেকে বহু দূরে সরে গেছে। এটা এখন একটা গুপ্তবিদ্যার মতো কিছু আচার ও ঐতিহ্যের মধ্যে সীমিত হয়ে গেছে।

রবীন্দ্রনাথ: তোমাদের এই খুবই জটিল সংগীতের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থাকতে হয়। ভারতে একজন শিল্পী কতটা স্বাধীনতা নিয়ে থাকেন, তা নির্ভর করে তার ব্যক্তিত্ব কতটা সৃজনশীল তার ওপর। একজন শিল্পী একজন সুরকারের সংগীত তার নিজের মতো করে গাইতে পারেন, তাকে যে সুরটা ফুটিয়ে তোলার জন্য দেওয়া হয়েছে, তাতে নিজের ব্যক্তিত্ব আরোপ করে ব্যাখ্যা করার মতো ক্ষমতা যদি তার থাকে, ওই সুরের সামগ্রিক নিয়মটা মেনে নিয়ে তা তিনি করতে পারেন।

আইনস্টাইন: এটা করার জন্য খুব উঁচু দরের শিল্পমান অর্জন করতে হবে, যা কিনা আদি সংগীতের নিহিত অর্থকে রূপায়িত করবে। যাতে করে একজন শিল্পী ভেরিয়েশন নির্মাণ করতে পারেন। আমাদের দেশে সাধারণত ভেরিয়েশন পূর্বপ্রস্তাবিত থাকে।

রবীন্দ্রনাথ: আমাদের ক্ষেত্রে যদি ভালোত্বের নিয়ম অনুসরণ করতে পারি, তাহলে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারি। আচরণের নিয়ম সেখানে আছে, কিন্তু আমাদের নিজস্ব সৃজনশীলতাই সত্য ও স্বতন্ত্র চরিত্র তৈরি করে।

আইনস্টাইন: গানের কথাও কি সেখানে মুক্ত? মানে আমি বলতে চাচ্ছি, একজন গায়ক কি গানের কথার সঙ্গে নিজের কথা গান গাইবার সময়ে যোগ করে দিতে পারেন?

রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ। বাংলায় এক ধরনের গান আছে-কীর্তন বলি আমরা। সেখানে গায়ককে এমন স্বাধীনতা দেওয়া হয় যে তিনি আসল গানে যে কথা নেই, সে ধরনের কথা, উক্তি, মন্তব্য যুক্ত করতে পারেন। এটা দর্শকশ্রোতাদের মধ্যে বিপুল আগ্রহ সৃষ্টি করে। কারণ শ্রোতারা গায়কের জুড়ে দেওয়া সুন্দর, স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের দ্বারা অভিভূত হয়ে ওঠে।

আইনস্টাইন: আঙ্গিকে মাত্রা কি সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ?

রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ। খুব গুরুত্বপূর্ণ। পদ রচনার সময় আপনি সীমা অতিক্রম করতে পারবেন না। গায়ক যতই ভেরিয়েশন আনুন, তিনি তাল এবং লয় রক্ষা করে চলবেন, যা বেঁধে দেওয়া। ইউরোপীয় সংগীতে আপনি লয়ের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিতে পারবেন, সুরের বেলায় নয়।

আইনস্টাইন: ভারতের সংগীতে কি কথা ছাড়া গান গাওয়া হয়? একজন কি কথা ছাড়া গান বুঝতে পারে?

রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ। আমাদের ওখানে এমন গান আছে যাতে কোনো অর্থবোধক শব্দ নেই, যে শব্দ আছে, তা কেবলই স্বরলিপির বাহক মাত্র। উত্তর ভারতে সংগীত (মিউজিক) একটা স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম, বাংলার মতো গান সেখানে কথা ও চিন্তার প্রকাশের মাধ্যম নয়। এই সংগীত খুব জটিল, সূক্ষ্ম এবং সুরের সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগৎ এটা।

আইনস্টাইন: এটা কি পলিফোনিক?

রবীন্দ্রনাথ: যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, হারমোনি তৈরি করার জন্য নয়। বরং তা করা হয় লয় ঠিক রাখার জন্য এবং সংগীতে একটা ব্যাপ্তি ও গভীরতা যোগ করার জন্য। তোমাদের সংগীতে হারমনি যোগ করার ফলে কি সংগীত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?

আইনস্টাইন: কখনো কখনো খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনেক সময় হারমনি সুরটাকে খেয়ে ফেলেছে।

রবীন্দ্রনাথ: সুর ও হারমনি হলো চিত্রকলার রেখা আর রঙের মতো। একটা সাধারণ রেখাচিত্র পরিপূর্ণ সুন্দর হতে পারে, তাতে রং আরোপ করলে সেটা অর্থহীন ও অগুরুত্বপূর্ণ কাজে পর্যবশিত হতে পারে। আবার রেখার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ রং জুড়ে দিয়ে মহৎ ছবি আঁকা যেতে পারে, যতক্ষণ না তা রেখার মূল্যকে ধ্বংস ও হত্যা করে।

আইনস্টাইন: আপনি একটা সুন্দর তুলনা দিয়েছেন। রেখা রঙের চেয়ে অনেক পুরোনো। তার মানে আপনাদের সুরের কাঠামো আমাদের সুরের চেয়ে অনেক বেশি ঋদ্ধ। জাপানের সংগীতও তেমনি।

রবীন্দ্রনাথ: আমাদের মনের ওপর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীতের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করা আমাদের জন্য খুব কঠিন। পশ্চিমা সংগীত আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। আমি অনুভব করি, এটা মহান। এর কাঠামো বিস্তৃত, এর কম্পোজিশন বিশাল। আমাদের নিজস্ব সংগীত আমাকে বেশি স্পর্শ করে এর মৌলিক গীতল আবেদনের মাধ্যমে। ইউরোপীয় সংগীত চরিত্রের দিক থেকে মহাকাব্যধর্মী, এর একটা বিস্তারিত পটভূমি আছে এবং গঠনের দিক থেকে এটা গথিক।

আইনস্টাইন: এই প্রশ্নের উত্তর আমরা ইউরোপীয়রা দিতে পারব না। আমরা এটাতে খুব বেশি অভ্যস্ত। আমরা জানতে চাই, ইউরোপীয় সংগীত কি একটা আচরিত অনুভূতি, নাকি মৌলিক মানবিক অনুভূতি। এর ঐক্যতান এবং তান-অনৈক্য যে আমরা বুঝতে পারি, সেটা কি প্রচলিত আচার থেকে, নাকি এটা প্রাকৃতিকভাবেই আমরা লাভ করি।

রবীন্দ্রনাথ: যেভাবেই হোক, পিয়ানো আমাকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়, বেহালা (ভায়োলিন) আমাকে অনেক বেশি প্রীত করে।

আইনস্টাইন: এটা খুব মজার ব্যাপার হবে-একজন ভারতীয় যিনি ছোটবেলায় পশ্চিমা সংগীত শোনেননি, তার ওপর পশ্চিমা সংগীতের প্রভাব কী রকম হয়, সেটা পরীক্ষা করে দেখা।

রবীন্দ্রনাথ: আমি একবার এক ইংরেজ সংগীতবিদকে বলেছিলাম আমাকে কিছু ধ্রুপদি সংগীত ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে, কোথায় কোন উপাদানের মধ্যে এই সংগীতের সৌন্দর্য নিহিত, তা বলে দিতে।

আইনস্টাইন: মুশকিল হলো, কী পশ্চিমা, কী প্রাচ্যীয়, আপনি ভালো সংগীতকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে পারবেন না।

অলংকরণ: বাবুল হোসাইন সোহাগ

রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ। যা গভীরভাবে নাড়া দেয়, তাতে শ্রোতা আর নিজেতে থাকেন না।

আইনস্টাইন: এই অনিশ্চয়তা সর্বক্ষণ ও সর্বত্র বিরাজ করে আমাদের প্রতিটা মৌলিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে, শিল্প বিষয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে-তা ইউরোপে হোক আর এশিয়ায় হোক। এমনকি আপনার টেবিলে পড়ে থাকা গোলাপটি আমার চোখে আর আপনার চোখে একই রকমের না-ও হতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ: এবং সর্বক্ষণ চেষ্টা চলছে ব্যক্তির নিজস্ব রুচির সঙ্গে বিশ্বজনীন মানের মধ্যে মিলন সাধনের।

এই আলোচনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি, আইনস্টাইন শেষ করছেন তার আপেক্ষিকতার তথ্য দিয়েই যে গোলাপ দুজনের চোখে এক না-ও হতে পারে। রবীন্দ্রনাথে এটা আমরা পাই, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ’ এই উক্তির মধ্য দিয়ে। তবু রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত পরম সত্তার সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষী, তিনি তার সমন্বয়ধর্মিতা বা মিলনসাধনের কথা দিয়েই শেষ করেছেন, যেন ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা প্রভু তোমার পানে।

তবে আমাদের জন্য পার্থিব নগদ লাভ হলো, সংগীত বিষয়ে, গায়কি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা মনোভাবের প্রত্যক্ষ প্রমাণ লাভ করা। তিনি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন, এমনকি গানের কথার মধ্যে কীর্তনিয়ারা যে স্বতঃস্ফূর্ত নিজস্ব কথামালা যোগ করেন, তাতেও তার সম্মতি ছিল, কিন্তু তিনি যেটা চেয়েছেন মূল স্রষ্টার সুরের আদি নিয়মটা, অভিপ্রায়টা যেন কঠোরভাবে মানা হয়। আমি সংগীতের লোক নই, কাজেই এর ব্যাখ্যায় আমি যাব না। শুধু বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি উদার ছিলেন, মোটেও রক্ষণশীল ছিলেন না।