রন্টির লাল জামা

রন্টির লাল জামাঅলংকরণ: তুলি

রন্টি রাস্তার পাশে অন্য ছেলেদের সঙ্গে খেলা করছে। ১০-১১ বছর। এবার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। অন্য ছেলেদের তুলনায় বয়স একটু বেশি। দেখতে ক্লাসের সবার চেয়ে লম্বা। বয়সের তুলনায় ঠিকমতো ক্লাসে না ওঠাটা রন্টির দোষ নয়। দুই বছর ধরে লেখাপড়া একেবারে বন্ধ ছিল। তারা মিরপুরে আদাবাড়ি এলাকায় থাকত। করোনার সময় কোনো লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না বললেই চলে। ৪-৫ মাস ধরে গ্রামে নানির বাড়িতে চলে এসেছে। শহরে তাদের থাকা কষ্ট হয়ে পড়ছে। বাবা রিকশা চালাত। ভালোই চলছিল তাদের। হঠাৎ করে করোনার কারণে সব সুখ চলে যায়। এর মধ্যে কয়েক মাস ধরে বাবা নিখোঁজ। যেই করোনা কমে এল, তাদের নতুন করে আরেক বিপদ দেখা দিল। সমস্যায় পড়ে যায় মা ছালেহা। ছোট বোনটিকে ঠিকমতো খাবার দিতে কষ্ট হয়। রন্টিও কয়েক মাস একটি চায়ের দোকানে দিনমজুরির কাজ করে। মা পরের বাসায় ঝিয়ের কাজ নেয়। তা-ও একদিন চলে যায়, কয়েক দিন কাজ বন্ধ দেওয়ার জন্য। কাজ করতে না যাওয়ার কারণ ছোট বোন পিউর ডায়রিয়া মরে যাওয়ার অবস্থা। কয়েক দিন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিল। শরীর সুস্থ হওয়ার পর কাজ করতে গেলে দেখে তার জায়গায় আরকজনকে নেওয়া হয়েছে। ছালেহার মোবাইল নেই, বাড়ির খালাম্মাকে জানানোর সুযোগ হয়নি। বাসাভাড়া বাকি, সংসার চালানো কঠিন। উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে একদিন গ্রামে মায়ের কাছে চলে আসে। বাবা বেঁচে নেই।

একমাত্র ভাই সে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। শত হলেও মায়ের মন। যত কষ্টে থাকুক, সন্তানকে ফেলা যায় না। ছালেহা বলে, ‘আমি যা খামু তুই তা খাবি। আমি না খাইলে তুইও না খাইয়া থাকবি।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয় সরকার। গ্রামের একটি স্কুলে রন্টিকে ভর্তি করিয়ে দেয় ছালেহা। ছালেহা চেয়েছিল আরেকটা ওপরের ক্লাসে ভর্তি করাবে। স্যার তার পড়ালেখার অবস্থা দেখে বললেন, ওকে তৃতীয় শ্রেণিতে করালে ভালো হবে। ছালেহা বলে, ‘স্যার, আপনি যা ভালো মনে করেন।’
রোজার কারণে এখন স্কুল বন্ধ। ঈদের আর এক সপ্তাহ বাকি। রাস্তার পাশে খেলতে গিয়ে দেখে, দল বেঁধে নারী-পুরুষ, তার বয়সী ছেলে-মেয়েরা ছুটছে। রন্টি খেলার সাথি সেলিমকে জিজ্ঞেস করে, ‘এত মানুষ কোথায় যায় দল বেঁধে?’
সেলিম বলে, ‘আজ বড় বাড়ি জামাকাপড় আর ইফতারি দেবে। আমার মা সেই সকালে চলে গেছে। তোর মা যায়নি!’
রন্টি বলে, ‘জানি না তো, মা বাড়িতে বসে আছে।’
সবাই আবার খেলায় মন দেয়।

রন্টি খিদে লাগছে বলে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। দেখে মা ঘরে বসে কী যেন করছে। রন্টি বুঝতে পারে, তাদের নামে কোনো কার্ড দেওয়া হয়নি। মাকে কিছু না বলে মানুষের সাথে হাঁটা শুরু করে। একসময় বড় বাড়ির সামনে চলে আসে। এসে দেখে, এখানে মহা হুলুস্থুল। মানুষ আর মানুষ। গেট দিয়ে ঢোকা তো দূরের কথা, এর কাছে যাওয়া তার সম্ভব নয়। অন্য মানুষের সঙ্গে রাস্তার পাশে দাঁড়ায় সে। রন্টি কয়েকবার গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেছে, ঢোকা যায়নি। গেটের দারোয়ান বড় একটি লাঠি নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় গেলেই মোটা একটা লাঠি দিয়ে আঘাত করবে। লোকজনের হইচই আর হুড়োহুড়িতে টিকতে না পেরে রন্টি একটু দূরে একটি গাছের নিচে ছায়ায় বসে। বসে থাকতে থাকতে দক্ষিণা হালকা বাতাস পেয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল তার জানা নেই। একসময় ঘুম ভাঙে। দেখে এখানে কোনো মানুষ নেই। হইচই, ভিড়, মানুষের ঠেলাঠেলি কিছুই নেই। শান্ত পরিবেশ। সামনের তাকিয়ে দেখে বিরাট গেটটা বন্ধ। সেই দারোয়ানও নেই। একজন মানুষও পাওয়া গেল না সেখানে। রন্টির ভীষণ কান্না পায়। চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে লাগল। সে এখানে নতুন এসেছে। কেউ তাকে ভালো করে চেনে না। গেটের কাছে গিয়ে ভেতরে দেখার চেষ্টা করে লোহার গেট ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। এ মুহূর্তে বাবাকে খুব মনে পড়ে। রোজার ঈদ এলে বাবা ফুটপাতের দোকান থেকে সুন্দর লাল জামা আর প্যান্ট কিনে দিত। বাবা কোথায় চলে গেল জানে না রন্টি। চোখে পানি আর মনটা খারাপ করে বাড়ি ফেরে।