যেভাবে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

প্রতীকী ছবি
সংগৃহীত

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র একটি অস্থায়ী বেতার সম্প্রচার স্টেশন। একাত্তরের ২৬ মার্চ এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ স্বাধীনের পর কেন্দ্রটির নাম হয় বাংলাদেশ বেতার।

সাতচল্লিশের দেশভাগের পরই এ অঞ্চলের মানুষ বুঝতে পারে যে সত্যিকার অর্থে পূর্ব বাংলা স্বাধীন হয়নি। সেই থেকেই চলে তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই সংগ্রামের সূচনা। তারপর নানা কারণে বিভিন্ন সময় আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। একাত্তরের মার্চ থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে রাজপথ। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আসে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ। এ ভাষণে মূলত তিনি দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

তারপর আসে সেই দুঃসহ কালরাত ২৫ মার্চ। সে রাতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল এই শহর। নিস্তব্ধ চারদিক। এমন সময় হানাদার বাহিনীর হঠাৎ আক্রমণ। এক ভয়ংকর বীভৎসতায় কেঁপে ওঠে আকাশ–বাতাস। অপারেশন সার্চলাইট নামে পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চলে হত্যাযজ্ঞ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্যাংক-মর্টার ও মেশিনগানের গুলি চলে। চারদিকে দাউ দাউ করে ওঠে আগুনের লেলিহান শিখা। মধ্যরাতের সেই ঢাকা যেন হয়ে ওঠে লাশের শহর।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছেন মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১
ছবি: সংগৃহীত

এদিকে গ্রেপ্তার করা হয় বাঙালির মাটি ও মানুষের নেতা, শতবর্ষের দাসত্বমুক্তির অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকে। তবে গ্রেপ্তারের পূর্বে তিনি তাঁর আজন্ম আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটান। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের। এটি ছিল যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান। কোটি বাঙালির হৃদয়ে তখন স্বাধীনতার স্বপ্ন। কিন্তু তারা বুঝে উঠতে পারছে না কী করতে হবে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর তরুণেরা প্রতিরোধের আগুনে মৃত্যুর ঝুঁকি নিচ্ছে।

ঠিক তখনই জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। এই বেতার কেন্দ্রই সেদিন বাঙালিকে যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার রাতে, নিরস্ত্র বাঙালির লাশের ওপর দাঁড়িয়ে পাক সামরিক জান্তা যখন মৃত্যুর মিছিলকে দীর্ঘ থকে দীর্ঘতর করছিল, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতিকে দিয়েছিল সর্বাত্মক যুদ্ধের নির্দেশনা।

২৫ মার্চ প্রায় রাতভর চলে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। তারপর আসে ২৬ মার্চ ভোর। চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। অনেকে এ ঘোষণার লিফলেট হাতে পান। এটি ছিল একটি ইংরেজি সাইক্লোস্টাইল কপি। এর অনুবাদ করে আরও কপি করা হয়। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। বেলা প্রায় ২টা ১৫ মিনিট। সে সময় এম এ হান্নান ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ বাদামতলী বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ওই বার্তা প্রথম পাঠ করেন।

তখন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে বাঙালিরা চাকরি করতেন। তাঁদের মধ্যে লেখক শিল্পী বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল্লাহ আল ফারুক, চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি কলেজের সহ–অধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপসহ কয়েকজন বেতার কেন্দ্র চালুর কথা ভাবেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। এখন এর পক্ষে দেশে-বিদেশে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে হবে। উদ্বুদ্ধ করতে হবে সবাইকে। আজকের মতো যোগাযোগব্যবস্থা তখন ছিল না। ছোট শহরে কাগজ পৌঁছাত প্রায় এক দিন পর। তাই বেতারই ছিল একমাত্র মাধ্যম যার সাহায্যে মানুষের কাছে পৌঁছানো যেত।

এই ভাবনা থেকেই তাঁরা চট্টগ্রাম বেতারকে কাজে লাগানোর চিন্তা করেন। তখন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র ছিল আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায়। সেখানে ছিল নিরাপত্তার ঝুঁকি। সৈয়দ আবদুল কাহ্হার ছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক। বেলাল মোহাম্মদ তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। জনাব কাহ্হারের কথা হলো, কোনোভাবেই যেন আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচার করা না হয়। কারণ, যেকোনো সময় আগ্রাবাদ ও বেতারের পতন হতে পারে। তার ওপর চট্টগ্রাম বন্দরে রয়েছে পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ সোয়াত ও বাবর। এখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা প্রয়োজন। হঠাৎ শেলিং শুরু হয়ে যেতে পারে। প্রায় প্রতিটি বেতারের একটা ইমার্জেন্সি স্টুডিও থাকে। তখন কালুরঘাটে চট্টগ্রাম বেতারের এ রকম একটি স্টুডিও ছিল। আর এটা চট্টগ্রাম থেকে মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বেও ছিল। বেলাল মোহাম্মদসহ সবাই কালুরঘাট ইমার্জেন্সি স্টুডিওতে চলে যান।

মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্দীপক অনুষ্ঠান শুনছেন
ছবি: সংগৃহীত

২৬ মার্চ। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিট। জাতি এক দুর্বিষহ কঠিন সময় অতিক্রম করছে। এমন এক পরিস্থিতিতে তাঁরা কালুরঘাট ইমার্জেন্সি স্টুডিওর নাম রাখেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।’ সেখান থেকে প্রথম যে বাক্য ভেসে আসে তা হলো, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি।’ সেদিনের এই ভেসে আসা কণ্ঠ ছিল চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি কলেজের সহ–অধ্যক্ষ আবুল কাশেম সন্দ্বীপের।

অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন তিলাওয়াত করেন চট্টগ্রামের গীতিকার ও কবি আবদুস সালাম। এরপর তাঁর বীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘প্রিয় বাংলার বীর জননীর বিপ্লবী সন্তানেরা, স্বাধীনতাহীন জীবনকে ইসলাম ধিক্কার দিয়েছে। আমরা আজ শোষক প্রভুত্বলোভীদের সাথে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি। এই গৌরবোজ্জ্বল স্বাধিকার আদায়ের যুদ্ধে, আমাদের ভবিষ্যৎ জাতির মুক্তিযুদ্ধে মরণকে বরণ করে জানমাল কোরবানি দিচ্ছি। কোরআন কারিমের ভাষায়, তাঁরা মৃত নহে, অমর। দেশবাসী ভাই-বোনেরা, আজ আমরা বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম করছি। জয় বাংলা।’

সে অনুষ্ঠানে এম এ হান্নানসহ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি আবার পাঠ করেন। তাঁরা প্রায় ৪০ মিনিট অনুষ্ঠান করেন। চট্টগ্রাম বেতারের সম্প্রচারক্ষমতা ছিল ১০ কিলোওয়াট। কালুরঘাট ইমার্জেন্সি স্টুডিও ব্যবহারের সময় ওই ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাই ব্যবহার করা হয়। পরদিন সকাল সাতটায় পরবর্তী অনুষ্ঠান সম্প্রচারের ঘোষণা দিয়ে সেদিনের পর্ব শেষ করেন।

এরই মধ্যে জরুরি হয়ে পড়ে বেতারের নিরাপত্তা। তখন মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন পটিয়ায়। ২৭ মার্চ বেতারের নিরাপত্তার জন্য তাঁর সাহায্য চাওয়া হয়। তিনি ব্যবস্থা করেন। সিপাহিরা তিনটি লরিতে বেতার কেন্দ্রে এসেছিলেন। কয়েকজন ক্যাপ্টেনকে নিয়ে মেজর জিয়া নিজেও যাত্রা করেছিলেন।

২৬–২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছেন। কিন্তু ওই সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার ঘোষণা ছিল সময়োপযোগী। হানাদার বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। সেই সময় একজন বাঙালি মেজরের কণ্ঠ সবাইকে আরও বেশি আশ্বস্ত করেছিল যে বঙ্গবন্ধু ও বাঙালিদের নিজস্ব সামরিক বাহিনী আছে।

স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র; ছোট্ট একটি নাম। কিন্তু কী দুর্নিবার শক্তি ছিল এই নামের। স্বাধীনতার এত বছর পর আজ সেটা কল্পনা করাও কঠিন। এই কেন্দ্রের প্রথম অনুষ্ঠান শোনামাত্র অনেকে অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। সে অশ্রু ছিল আনন্দের, গৌরবের, গভীর আত্মবিশ্বাসে ঘুরে দাঁড়ানোর। এই বেতার দিয়েছিল শত্রুর ওপর আঘাত হানার নতুন প্রেরণা।

এখান থেকেই সেদিন পৃথিবীর মানুষ জেনে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। এ ঘোষণা বাঙালি জাতিকে দিয়েছিল এক সর্বাত্মক যুদ্ধের নির্দেশনা।

এই বেতারের বরাত দিয়ে সেদিন পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করেছিল। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সংবাদ বিশ্বের জনগণের কাছে ছড়িয়ে পড়েছিল। ইয়াহিয়া খানের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ছিল দিশেহারা, চারদিকে অন্ধকার। এ যেন মৃত্যুর মুখে অসহায় আত্মসমর্পণ। এমন একটি পরিস্থিতিতে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। কিন্তু এই বিপ্লবী বেতারের আয়ু ছিল মাত্র দুই দিন। ২৬ ও ২৭ মার্চ। ২৮ মার্চ মেজর জিয়ার অনুরোধে বিপ্লবী শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। তারপর এর নতুন নাম হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

এই বেতার কেন্দ্রে বিভিন্ন সময় অনেকেই যুক্ত হয়েছেন। আবার চলেও গেছেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের ১০ জন সদস্য শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। এঁদের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী ও পরবর্তী কালে বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।

শুরুতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম বেতারের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি। আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্রের কর্মীরা ও স্থানীয় লোকজন মিলে দারুণ এক সাহসী পদক্ষেপ নেন। সেদিন তাঁরা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে যে সাহস ও বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, সে জন্য দেশের মানুষ তাঁদের আজীবন মনে রাখবে। তাঁরা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র নাম দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার শুরু করেছিলেন। এ কেন্দ্র থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দেশে ও বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা ছিল বিস্ময়কর। ভয়াবহ দুঃসময়ে সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালির মনোবলকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য এই বেতার কেন্দ্রের কলাকুশলীরা নিরন্তর কাজ করে গেছেন। বেতার কেন্দ্রের একেকটি শব্দ যেন একেকটি বুলেট হয়ে বেরিয়েছে। তাঁদের সৃষ্টিশীল অনুষ্ঠানমালা মুক্তিযুদ্ধের গতি এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।

স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রথম পর্ব ছিল কালুরঘাট। দ্বিতীয় পর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বাগাফা জঙ্গল ও আগরতলা। তৃতীয় পর্ব ২৫ মে কলকাতায়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে এটি বাংলাদেশ বেতার নামে চলছে। এই কেন্দ্র সেদিন এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে স্বপ্ন দেখিয়েছিল যুদ্ধজয়ের।

আশফাকুজ্জামান, কলামিস্ট, সাংবাদিক ও সংগঠক