মৃত্যুময় পৃথিবীতে চিরহরিতের গান

ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভবনের সামনে এই প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
ছবি: কবির হোসেন

‘প্রদীপের পর প্রদীপ জ্বলে উঠতে লাগল। হয়তো কিছুটা অবিন্যস্তভাবে, বিক্ষিপ্ত প্রক্রিয়ায়। তবু স্পষ্ট হয়ে উঠল: আমাদের যাত্রা চলতে শুরু করেছে। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়া, শুধু দিগন্ত আক্রমণ।
...
এখন চাই দীর্ঘ পথপরিক্রমী পত্রিকা। সবকিছুকে, সব প্রবণতাকে ধারণ করে, সবাইকে সেই দূরদেশে পৌঁছে দেবার মতো মুখপত্র। চাই সেই সাম্পান, সেই ভালোবাসার সাম্পান।
ভালোবাসা না হলে মৃত্যু আর রক্তসংকুলতার পথে কী করে বাঁচব আমরা?’

‘কণ্ঠস্বর’ সাহিত্যপত্রিকার আবির্ভাবের পটচিত্রকে এভাবেই ‘ভালোবাসার সাম্পান’ বইয়ে অনুপম অক্ষরায়িত করে রেখেছেন আবদু্ল্লাহ আবু সায়ীদ।

‘সংবাদ’ সাময়িকীতে প্রকাশমুহূর্তে এই ধারাবাহিকটির জন্য বৃহস্পতিবার আমাকে অপেক্ষায় রাখত। আর ২০০২-এ ‘মাওলা ব্রাদার্স’ থেকে বই হয়ে বেরুনোর পর ২০০৬-এর দ্বিতীয় মুদ্রণ উপহার দিয়েছিলেন প্রিয় সোমেল ভাই। উপহারের পাতায় লেখা দেখছি ‘০২.০২.০৬, রাত ৯.০৫’। এই তো সেদিন ‘ভালোবাসার সাম্পান’ রচয়িতার জন্মদিনের দুপুরে বইটা আবার পড়া শুরু আমার। পড়েছি, ভেবেছি—প্রতিটি বড় স্বপ্নের সমুদ্রে যথাযোগ্য ভাসতে গেলে সাম্পানের দরকার পড়ে, ভালোবাসার দড়িদড়া, মাস্তুলে গড়া সাম্পান; তখন দিনের পর দিন অন্ধকার প্রেসে বসে সাহিত্যের আগন্তুক ঋতুর সবুজ নকশা মুদ্রণই হোক কিংবা কাছের মেট্রোপলিটন আর দূর মফস্বলের শিশু-কিশোরের হাতে ‘পথের পাঁচালী’, ‘বাঙালির হাসির গল্প’ বা ‘রহস্যের দ্বীপ’ পৌঁছে দেওয়া হোক—সবই ভালোবাসাময় অনিবার্য কর্ম মনে হতে পারে অনায়াসে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এমনভাবেই আবহমান কর্মসুন্দরে, ভালোবাসার সাম্পানে।

মনে পড়ে ছোটবেলায় এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি ‘সাম্পান’ শব্দটির প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা বলেছিলেন। তাঁর কণ্ঠেই শুনেছি প্রথম রফিক আজাদের সেই কবিতা—
‘সুন্দর সাম্পানে চড়ে
মাধবী এসেই বলে যাই।’

বুঝেছি সুন্দর তো এমন; ক্ষণপ্রভা কিন্তু চিরহরিৎ। যেমন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটি কবিতার বইয়ের নাম ‘মৃত্যুময় ও চিরহরিৎ’। যতটা তাঁর সংগঠন নিয়ে কথা হয়, ততটা হয় না তাঁর কবিতা ও গদ্য বিষয়ে। তবে এ নিয়ে কোনো খেদ নেই তাঁর। কারণ লেখা ও সাংগঠনিকতা তাঁর কাছে পৃথক কিছু নয়। সবেতেই তো ভালোবাসা আর স্বপ্নের আঁচড় কাটা।

এই আমি সেই দূর কৈশোর এক মফস্বল শহরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচির পুরস্কার নিতে গিয়ে সামনাসামনি প্রথম দেখি ও শুনি তাঁকে। বলছিলেন, ‘বই পড়ে আবার পুরস্কার কেন? বই পড়াই তো মানুষের জন্য এক শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।’ আমরা আমাদের অভিভাবকদের নিয়ে গিয়েছিলাম সে অনুষ্ঠানে; যেন সায়ীদ স্যারের কথার সম্মোহনে মুগ্ধ হয়ে আমাদের কেন্দ্রে পাঠাতে আর কখনো ইতস্তত না করেন। হলোও তাই। বললেন স্যার, ‘আপনারা সবাই ভালো ছেলেমেয়ে চান। ভালো ছেলেমেয়ে তো পানি নয় যে টিউবওয়েলে চাপ দেবেন আর বালতিতে তা পেয়ে যাবেন। এর জন্য দরকার তাদের মননের জাগরণ। বই পারে সে কাজটি করতে।’

আমি একজীবনে এবং মনে করি আমরা অনেকেই ঋণী বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে। কারণ, যখন আমাদের কৈশোরে টেলিভিশন ছিল অবিকল্প বিনোদনমাধ্যম, তখন কেন্দ্র ও তার সূত্রেই তো ‘পথের পাঁচালী’র পাঠ নিয়েছি। কুমিল্লায় বসে চলে গেছি নিশ্চিন্দিপুরে, নিজেকে ভেবেছি অপু, বোনকে ভেবেছি দুর্গা। আর তারপর চিরকালের মাঠের পাড়ের দূরের দেশে যেতে পারার ভিসা পেয়ে গেছি মনে মনে। আমার বেড়ে ওঠার কাল সোনায় মুড়ে দিয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র; ‘নূরনবী’, ‘ছেলেদের মহাভারত’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘হোয়াইট ফ্যাঙ’, ‘রবীন্দ্রনাথ: কিশোর জীবনী’ কিংবা ‘তুমি এখন বড়ো হচ্ছ’-এর মতো বই। কেন্দ্র প্রকাশিত বইয়ের আখ্যাপত্রে লেখা থাকত একটি কথা ‘বইটি আপনার জীবনকে দীপান্বিত করুক’। সত্যি, হাজার-লক্ষ দীপশিখাকেন্দ্র বাংলাদেশের শিশু-কিশোর-তরুণের প্রাণের অঙ্গনে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। আজ যখন কেউ কেউ প্রশ্ন তোলে, ‘সমাজে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অবদানটা কী?’ তখন উত্তর দিতে ইচ্ছে করে, ‘কিছু অবদানের কোনো শুমারি হয় না। কিছু স্বপ্ন ও ভালোবাসা অন্তরের আলোর সঙ্গে এমনভাবে মিশে থাকে যে তার কথা আলাদা করে বলতে যাওয়া কুৎসিত মনে হয়। কেন্দ্র ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কোনো অবদানের গলাবাজি করতে চাননি কখনো বরং সুন্দরের গানে গলা সাধতে শিখিয়েছেন আমাদের।’

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কয়েক খণ্ডের আত্মকথা ‘নিষ্ফলা মাঠের কৃষক’ আমাদের নতুন করে দেখতে শেখায় ফেলে আসা শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় থেকে ব্যক্তিজীবনের লঘুমুহূর্ত। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন সপ্রাণ ব্যক্তিই সমষ্টির বিকাশসূত্র। ‘আমার উপস্থাপক জীবন’, ‘সংগঠন ও বাঙালি’, ‘আমার অনুভূতিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’, ‘রষ্ট্রাম থেকে’, ‘নিউইয়র্কের আড্ডায়’-এমন আরও বইয়ে কখনো প্রবচনের ঢঙে কখনো বিশদ বয়ানে তিনি আমাদের বলে চলেন তাঁর প্রাণের কথা। ছাতার মতো সংগঠন গজিয়ে ওঠার দেশে ‘সংগঠন ও বাঙালি’ লেখার মতো মানুষ কিন্তু একজনই—আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। আমি তো মনে করি গোটা বাংলা ভাষা এলাকাতেই ‘সংগঠন ও বাঙালি’র মতো বই বিরল। সমসাময়িক কোনো গদ্যকারের সঙ্গে তাঁর মিল নেই মোটেও; তিনি অনুভবের অতল থেকে আহরিত কবিতার তীব্র আবেগদ্যুতির ঝিনুকে গড়া কলমে যেন গদ্য লেখেন। ফলে তাঁর গদ্য, তাঁরই বইয়ের শিরোনামের মতো হয়ে ওঠে ‘রোদনরূপসী’ আর তারা গান গায় ‘ব্রাহ্মণের বাড়ির কাকাতুয়া’র সুরে।

সৃষ্টিশীলতার বহু সূত্র-প্রতিসূত্র আছে। সেসবের তলকূল পাই না আমি। তবে আমাদের জীবদ্দশায় আমরা দেখে চলেছি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে; যিনি ষাটের দশকে গাঁটের পয়সা খরচ করে, গায়ের ঘাম ঝরিয়ে, স্বপ্নের সোনাদানায় প্রকাশ করেছেন নতুনতাকামী সাহিত্যপত্র ‘কণ্ঠস্বর’। সেই একই সৃষ্টিমগ্নতায় তিনি টেলিভিশনে কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন বোলপুরের রুক্ষ মাটি কেটে একটু একটু করে গড়েছেন স্বপ্নের শান্তিনিকেতন, তেমনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রায় শূন্য হাতে, কোটি বাঙালির স্বপ্নকে সম্বল করে গড়ে তুলেছেন ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র’। সফলতা-ব্যর্থতার হিসাব করেননি কখনো। কারণ, স্বপ্ন তো সীমানাহীন। স্বপ্ন মহৎ স্বপ্নের আনন্দ-আভাতেই।

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এক প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেওয়া বক্তৃতায় কেন্দ্রের শুরুর দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে জানালেন, একবার সমাজের এক পদস্থ নারী রাগতস্বরে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই যে সায়ীদ সাহেব, আপনারা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র খুলে এত আদর্শ আদর্শ করছেন। এই সমাজে কি আদর্শের দাম আছে কোনো?’

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিনীত উত্তর, ‘আপনাকে কে বলল আপা যে আমরা দামের জন্য আদর্শের কথা বলি! আদর্শ ছাড়া মানুষ হয় না বলে আমরা আদর্শের কথা বলি।’

এমন একজন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে শুধু জন্মদিনে নয়, প্রতিদিনই শুভেচ্ছা জানাতে হয়; সঙ্গে রাখতে হয় তাঁর স্বপ্নের পসরা আর ভালোবাসার সাম্পান। ধন্যবাদ আপনাকে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মৃত্যুময় পৃথিবীতে আপনি চিরহরিতের গান শুনিয়েছেন আমাদের।