মুক্তিযোদ্ধা পাখি হাড়গিলা

মুক্তিযোদ্ধা পাখি হাড়গিলা। ছবি: সংগৃহীত

বন্ধুরা, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদ ও মা–বোনের আত্মত্যাগের কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। কিন্তু কোনো পাখিও যে যুদ্ধে অংশ নিতে পারে, তা কি কখনো সম্ভব? হ্যাঁ বন্ধুরা, এক সাহসী হাড়গিলা পাখিও মুক্তিযুদ্ধে নিজের সবটুকু শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শহীদ হয়েছিল।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতা সহ্য করতে না পেরে ২৫ মার্চ কালরাতে মিলিটারিদের আক্রমণ করে বসে একটি হাড়গিলা পাখি। আধুনিক চিত্রকলাচর্চার পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ছাত্রছাত্রীদের জীবজন্তুর ছবি আঁকার সুবিধার জন্য একটি ছোটখাটো চিড়িয়াখানা নির্মাণ করেন। কারণ, চারুকলা অধ্যয়নের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে ফিগার ড্রইং। এ জন্য চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের মানুষ ও জীবজন্তুর ছবি আঁকার অনুশীলন করতে হয়। শিল্পাচার্যের নির্মাণ করা চিড়িয়াখানাটি আকারে ছোট হলেও তাতে হরিণ, বানর, হাঁস, মুরগি, বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি ছিল। শিল্পীর তুলিতে ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে উঠত এসব প্রাণী৷ প্রতিদিন অনেক মানুষ তাঁদের শিশুদের নিয়ে এই চিড়িয়াখানা দেখতে আসতেন। মায়া হরিণের মায়াবী চোখ আর বাঁদরের বাঁদরামি ছোট শিশুদের পাশাপাশি বয়স্ক লোকদেরও আনন্দ দিত। চিড়িয়াখানাটি ছিল বর্তমান বকুলতলার উত্তর পাশে।

এখনকার মতো ষাটের দশকেও নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো এখানে। চারুকলা প্রাঙ্গণে ছিল অসংখ্য রঙিন ফুলের বাগান। জয়নুল আবেদিন এখানে রোপণ করেন নানা ধরনের বৃক্ষ। সব মিলিয়ে যা ছিল অতি দৃষ্টিনন্দন। জয়নুল আবেদিন ছবি আঁকার জন্য একদিন একটি হাড়গিলা পাখি নিয়ে আসেন। সেটি ছিল পোষা পাখি। তাই উড়তে পারত না। বকুলতলার মাঠে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত। ফলে শিল্পীরা সহজেই কাগজে, ক্যানভাসে সেই পাখির ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। বকুলতলায় হাড়গিলা পাখির চারদিকে গোল হয়ে ইজেল, রং, তুলি, কলম, পেনসিল, কাগজ, ক্যানভাস নিয়ে চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা বসে পড়তেন ছবি আঁকতে। হাড়গিলা ছিল তাঁদের সবার মধ্যমণি। ছবি আঁকার পাশাপাশি চলত গান, কবিতার আসর। হাড়গিলা পাখিটি ছিল সেসবের নীরব শ্রোতা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, ইপিআরের পাশাপাশি হায়েনাদের নৃশংসতা থেকে মুক্তি পায়নি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পকলাচর্চার তীর্থভূমি চারুকলা ইনস্টিটিউটও। বাঙালি জাতির প্রতি পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন এ দেশের চারুশিল্পীরা। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি শাসকের নির্যাতন ও গণহত্যার প্রতিবাদে পটুয়া কামরুল হাসান ইয়াহিয়ার প্রতিকৃতি দিয়ে একটি বিখ্যাত ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করেন ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ শিরোনামে। এখানে দানব আকারে দেখানো হয় ইয়াহিয়াকে, যা পাকিস্তানি হানাদারদের পৈশাচিকতার প্রতীক। শিল্পীর তুলির একেকটি আঁচড় খুনি জালিমের মসনদে কাঁপন ধরিয়ে দেয় আর বাঙালি জাতির মানসে তৈরি হয় পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি ঘৃণার স্ফুরণ। তাই স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানি হানাদারদের ক্ষোভ ছিল এই চারুকলা ইনস্টিটিউটের ওপর। পাকিস্তানি হানাদাররা একে একে হত্যা করে চারুকলা ইনস্টিটিউটে কর্মরত কর্মচারীদের। তারা ধ্বংস করে এ প্রতিষ্ঠানের একমাত্র ছাত্রাবাসটিও। পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে তৈরি করা ব্যানার, পোস্টার, ব্যঙ্গচিত্রগুলো এই ছাত্রাবাসের বিভিন্ন কক্ষে সংরক্ষণ করা হতো। পাকিস্তানি মিলিটারিরা ছাত্রাবাসে প্রবেশ করে ছাত্রদের কক্ষগুলোয় রক্ষিত পোস্টার, ব্যানার ও ব্যঙ্গচিত্রগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেয়। হত্যা করে ছাত্রাবাসের ছাত্র শাহনেওয়াজকে। তাদের হিংস্র বুটের তলায় পিষে ধ্বংস হয় শিল্পাচার্যের সাজানো ফুলের বাগান, বারুদের গন্ধে হারিয়ে যায় ফুলের সৌরভ। হানাদারদের গুলিতে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয় চারুকলার মালি নোনা মিয়ার। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে চিড়িয়াখানার জীবজন্তুরাও খাঁচার ভেতর ভয়ে ছোটাছুটি আর ডানা ঝাপটানো শুরু করে। হাড়গিলা পাখিটি উড়তে না পারায় ছিল খাঁচার বাহিরে।

হায়েনাদের নৃশংসতা সে নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করে। যে হাড়গিলা পাখি ওড়েনি কখনো, প্রচণ্ড গোলাগুলি উপেক্ষা করে তার বিশাল দুটি পাখায় ঝড়ের আওয়াজ তুলে উড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সৈন্যদের ওপর। আচমকা ধাক্কা খেয়ে দুই পাকিস্তানি হানাদার মাটিতে পড়ে যায়। পাখিটাও ঠোকর দিতে থাকে তাদের মুখে। হাড়গিলা একটি বিশাল আকৃতির পাখি। এর ঠোঁট প্রায় ৩৩.২ সেন্টিমিটার লম্বা, যা অত্যন্ত শক্ত, চোখা ও ধারালো। এই ঠোঁট দিয়ে ওরা যেমন জোরে জোরে ঠোঁটতালি বাজাতে পারে, তেমনি পারে বিপুল বিক্রমে শত্রুর শরীর ক্ষত–বিক্ষত করতে। ধারালো ছুরি কিংবা বেয়নেটের সঙ্গে তুলনা করা যায় এই ঠোঁটের। হাড়গিলার ঠোঁটের আঘাতে ওই পাকিস্তানি হানাদারের মুখ থেকে রক্ত বের হয়, একটা চোখ ঠোকরের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি পাখির আক্রমণে সাময়িক হতবিহ্বল হয়ে পড়ে দানবেরা। পরে অন্য হানাদারদের গুলিতে পাখিটি মারা যায়। চারুকলার সবুজ ঘাস লাল হয়ে ওঠে এই মুক্তিযোদ্ধা পাখির রক্তে, যে পাখি নিজের সবটুকু শক্তি উজাড় করে দিয়েছিল এই দেশ ও জাতির শত্রুদের বিনাশ করতে৷ এই মুক্তিযোদ্ধা পাখির ঘটনা আমি প্রথম জানতে পারি শরীফ খানের ‘চারুকলার সেই মুক্তিযোদ্ধা হাড়গিলা পাখিটি’ লেখা থেকে। চিত্রশিল্পী হাশেম খান তাঁর ‘স্বাধীনতা ও জরিনারা’ বইয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা পাখির সত্য ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীকালে ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে উর্দুভাষী পাকিস্তানি হানাদারদের মিলিটারি ক্যাম্প। অনেক বাঙালিকে এখানে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। চারুকলার মাঠে এখনো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে অসংখ্য শহীদের কবর। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নিজ হাতে বানানো চিড়িয়াখানাটিও ছারখার হয়ে যায়। হরিণ, হাঁস, মুরগির জীবন শেষ হয়ে যায় খুনিদের ভোজন উৎসবে। সেই মুক্তিযোদ্ধা পাখি হাড়গিলা শুধু রয়ে যায় চারুকলার ছাত্রছাত্রীদের হাতে আঁকা সেসব রঙিন ক্যানভাসে কিংবা পেনসিলে আঁকা কিছু কাগজের খসড়ায়।