মুক্ত বিহগ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কই গো, কোথায় গেলে? খাবার গুছিয়েছ? জলদি দাও। একদম হাতে সময় নেই। বলতে বলতে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামছে ঋজু। রিক্তা রান্নাঘর থেকে ঘামে ভেজা মুখখানা ওড়না দিয়ে মুছতে মুছতে টিফিন বক্সটা তুলে দিল ঋজুর হাতে। রিক্তা ভাবতেই পারিনি এই বয়সে এত দ্রুত সংসারের দায়িত্ব নিতে হবে।

রিক্তা সুন্দরী ও মেধাবী। তার স্বপ্ন লেখাপড়া শেষ করে কলেজের শিক্ষক হওয়ার। রিক্তা যখন এইচএসসি পরীক্ষা দেবে, তখন ঋজুর বাবা রিক্তাকে পছন্দ করে। ঋজুর জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। ঋজু একটা বিমা কোম্পানির কর্মকর্তা। রিক্তা কিছুতেই বিয়ের জন্য রাজি হয় না। কান্নাকাটি করতে থাকে। বাবার আর্থিক অসচ্ছলতার কথা সবাই রিক্তাকে বোঝাতে থাকে। কেউ কেউ বলে, মোটা ভাত, মোটা কাপড়। এমন ভালো ছেলে কোথায় পাবে? পড়শিরা বলে, মেয়েমানুষ, এত লেখাপড়া দিয়ে কী হবে?

যতই লেখাপড়া শিখুক না কেন, হাঁড়ি ঘুঁটতেই হবে।

বিয়েটা আর আটকাতে পারল না রিক্তা। ভালো ঘর, ভালো বর, এটাই কি মেয়েদের পরিচয়? না না এটা কখনো হতে পারে না। ভাবতে থাকে রিক্তা। নারী নয়, মানুষ হয়ে সে বাঁচতে চায়। আত্মনির্ভরশীল হতে চায়। জীবনের স্বাদ নিতে চায়। সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে চায়। এ স্বপ্ন সে কিছুতেই ভেঙে যেতে দিতে পারে না। বরপক্ষ কোনোমতেই পাত্রী ছাড়তে রাজি নয়। বর পক্ষকে যখন থামাতে পারল না, তখন রিক্তা একটা শর্ত দিল। শর্তটা ছিল তাকে লেখাপড়া করার সুযোগ দিতে হবে। ছেলের বাবা, ছেলে রাজি হলো শর্তে। কিন্তু ছেলের মা কোনো কিছুই বলেনি সেদিন। ইতিমধ্যে ধুমধামের সঙ্গে বিয়ে সম্পন্ন হলো।

নতুন জায়গা। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লেগে গেল রিক্তার। শাশুড়ি সংসারের ভার তুলে দিল রিক্তার হাতে। রিক্তা বিনয়ের সঙ্গে বলল,‘মা, আপনি যত দিন বেঁচে আছেন, তত দিন সংসার আপনার হাত থাকবে।’

এতে শাশুড়ি মনঃক্ষুণ্ণ হলো। শাশুড়ি চায় না রিক্তা আর লেখাপড়া করুক। এ জন্য শাশুড়ি এ কাজ, সে কাজ দিয়ে রিক্তাকে ব্যস্ত রাখে। রিক্তা সারা দিন সংসারের কাজ সেরে সন্ধ্যায় পড়তে বসে। পড়তে বসলেই বিভিন্ন কাজের অজুহাতে শাশুড়ি ডাক দেয়। এটা রিক্তা খেয়াল করে।

না, এর একটা সমাধান চাই। পড়াশোনা আমাকে করতেই হবে মনে মনে বলল রিক্তা। পরের দিন বিকেলে কাজ সেরে শাশুড়ির কাছে গেল। শাশুড়ি শুয়ে আছে। রিক্তাকে দেখে শাশুড়ি বলল বউমা, কিছু বলবে?

রিক্তা বলল, জি মা।

একটা কথা বলতে চাই।

বলো, কী বলবে?

রিক্তা বলল, মা, আমি আজ থেকে বিকেলে আপনার যত কাজ আছে সব করে দেব, কিন্তু পড়তে বসলে আমাকে ডাকবেন না প্লিজ। আমার পরীক্ষা তো বেশি দেরি নেই। সন্ধ্যা হলে আমি তো পড়তে বসি। তাই ওই সময়টা আমি পুরাপুরি পড়ার কাজে লাগাতে চাই।

শাশুড়িমা রেগেমেগে অস্থির।

কী বললে? আমার জন্য তোমার সমস্যা হয়?

এত বড় কথা!

কী করে তুমি বলতে পারলে?

রিক্তা বলল, না না মা।

আমি সেটা বলিনি। আপনি ভুল বুঝছেন।

ভুল বুঝে শাশুড়ি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

রিক্তা হতভম্ব হয়ে গেলে শাশুড়িমার কাণ্ড দেখে।

দিনে দিনে রিক্তার প্রতি শাশুড়ির মানসিক অত্যাচার বেড়ে গেল।

এসব সে কারোর কাছে কিছু বলে না। বাবার বাড়ি এসে পরীক্ষাটা দিল। রেজাল্ট ভালো হলো না। অন্য কোনো উপায় না দেখে বিষয়টা ঋজু ও শ্বশুরমশাইকে জানাল রিক্তা।

কিন্তু তাদের কাছ থেকে ইতিবাচক কোনো সাড়া মিলল না।

ঋজু বলল, আমি তোমার কোনো অভাব রাখিনি। কাজেই পড়াশোনার আর দরকার কী?

রিক্তা বলল, একি বলছ তুমি!

একজন সর্বোচ্চ শিক্ষিত মানুষের মুখে এ ধরনের কথা আশা করেনি রিক্তা।

কিন্তু কথা তো এটা ছিল না বলল রিক্তা। আমি শর্ত সাপেক্ষে বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। তোমরা আমাকে পড়াশোনা করতে দেবে বলেছিলে। তাহলে এখন অন্য কথা কেন হবে?

শ্বশুরকে বললে শ্বশুরও কোনো কথা বলেনি। রিক্তা বুঝে গিয়েছিল তার জীবনের মোড় কোন দিকে যাচ্ছে। তাহলে সবই মিথ্যা হয়ে যাবে?

না, না এটা আমি হতে দিতে পারি না।

যেকোনো মূল্যেই হোক আমার স্বপ্নপূরণ করতেই হবে। এদিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আরও একটা নতুন চাপ শুরু হলো। রিক্তাকে বাচ্চা নিতে হবে। সব মিলে রিক্তার জীবন নাভিশ্বাস হয়ে পড়ে।

রিক্তা কঠিনভাবে শপথ নিল সে হারতে রাজি নয়।

সে জানে অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া মেয়েদের কোনো মুক্তি নেই।

ভাবনার অস্থিরতা রিক্তাকে খুব কঠিনভাবে পীড়া দিতে শুরু করে।

আচ্ছা, মেয়েদের কেনো নিজস্ব কোনো পরিচয় থাকবে না? কোনো বাড়ি থাকবে না? মেয়েরা কি শুধুই পরগাছা?

অথচ মেয়েরা তো সবকিছুই করতে পারে।

বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি, ছেলের বাড়ি। তাহলে মেয়েদের বাড়িটা কোথায়? অমুকের মেয়ে, অমুকের বউ, অমুকের মা। তাহলে কি মেয়েদের নিজস্ব কোনো পরিচয় থাকবে না?

তাহলে মেয়েরা কী?

পরগাছা?

কে বা কারা করল এসব অনিয়মকে নিয়ম? কেন করল?

উদ্দেশ্যই–বা কী?

ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে যায় রিক্তা। মানি না এসব নিয়মকানুন। আমার পরিচয় আমি মানুষ। এর জন্য আমি লড়ব, নিজের পরিচয়ের জন্য লড়ব আমার অস্তিত্ব দিয়ে। দিনে দিনে সংসারে আরও তিক্ততা বাড়তে থাকল। শ্বশুরবাড়ি থেকে সাফ বলে দিল। পড়াশোনার আর দরকার নেই। শুনে পরের দিন রিক্তা বাবার বাড়ি চলে গেল।

মাসখানেক হয়ে গেল। এদিকে ঋজু ফোন করে জানিয়ে দিল, যদি না আসো তাহলে যেন তালাকটা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমি বিয়ে করতে চাই। রিক্তা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। কী শুনছে এসব! সে তালাকের কথা ভাবতেই পারে না। ভেবেছিল দুই পরিবার একসঙ্গে বসে এর একটা সমাধান করতে। কিন্তু তা আর হলো না।

রিক্তা মা–বাবাকে সব খুলে বলে। তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। তাই রিক্তার সিদ্ধান্তকে তারা না করল না। রিক্তা এক সপ্তাহের মধ্যে তালাক পাঠিয়ে দিল।

রিক্তা জীবনকে নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে থাকে। বাবার পাশে দাঁড়াবে। লেখাপড়া শেষ করবে। চাকরি করবে। আত্মনির্ভরশীল হবে। রিক্তার চোখে এক আকাশ স্বপ্ন। জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর দিকে ফিরে তাকাল না। সে নতুন করে শুরু করল জীবনের এক নতুন অধ্যায়। জীবনকে সে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিল। আবার পড়াশোনার দিকে মনোযোগ দিল। তারপর সব পরীক্ষায় বরাবর খুবই ভালো রেজাল্ট করল।

অবশেষে তার স্বপ্নপূরণ হলো। সে কলেজের শিক্ষক হলো। ক্লাসে মেয়েদের বোঝাতে থাকে বিয়ে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে না। নিজেকে নারী কিংবা মেয়েমানুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখো। আরও বলল, নিজের সংগ্রাম নিজেকে করতে হবে। সংগ্রাম, লক্ষ্য ও সাধনা ছাড়া ভালো কোনো কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। রিক্তা ক্লাস শেষে কলেজ চত্বরে খানিকক্ষণ দাঁড়াল। দেখল একঝাঁক মুক্ত বিহগ উড়ছে আকাশে।