মায়ের হাত ধরা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ঘড়িটা অ্যালার্ম দিয়েই যাচ্ছে, তবু মেয়েটার ঘুম থেকে ওঠার নাম নেই। রান্নাঘরে নাশতা রেডি করতে করতে মিনি বকে যাচ্ছে। ওর দুই মেয়ে আফ্রা ও নোভা। রোজ সকালে তার প্রথম কাজ মেয়ে দুটোকে পরিপাটি করে স্কুলে নিয়ে যাওয়া।
সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিকে পড়ছে ওরা। শাহেদ ব্যবসার কাজে এত ব্যস্ত থাকে যে মেয়েদের সব আবদার মিনিকে দেখতে হয়।
টেবিলে নাশতা গুছিয়ে রেখে মেয়েদের ধাক্কা দিয়েই উঠাল। নোভা দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল। আফ্রা এখনো গড়িমসি করছে। মিনির বোঝার বাকি রইল না যে ও এতক্ষণ ইচ্ছা করেই উঠছিল না।
—আফ্রা, নোভা রেডি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি কর, উঠছ না কেন?
—মা, আজ না গেলে হয় না।
—এমনটি করতে হয় না। অসুস্থ থাকলে মানা যেত। কিন্তু তুমি তো সুস্থ।
—আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। আজ না যাই (মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে)।
—উহু! একদম না, তাড়াতাড়ি রেডি হও।
এই ফাঁকে নিজেও রেডি হয়ে নিল। আজ মেয়েদের স্কুলে নামিয়ে মিনি মার্কেটে যাবে। মেয়েদের জন্য কেনাকাটা করতে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আফ্রা বলছে, মা, এমনও তো হতে পারে আমি আজ হারিয়ে গেলাম।
—কীভাবে? আমি আছি না! হারাতে দিলে তো। বের হওয়ার সময় এসব বলতে নেই।
মেয়েদের স্কুলের গেটে ঢুকিয়ে মিনি হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কত দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরছে। মনটা ভার হয়ে গেল। যাচ্ছেতাই মাথায় আসছে। পরক্ষণে হালকা হওয়ার চেষ্টা করল। আফ্রা বাসা থেকে বের হওয়ার আগে হারিয়ে যাওয়ার কথা বলার জন্যই এমনটি ঘটেছে। আফ্রার ওপর রাগ হলো মিনির।
মেয়েটা যে কী? এসব বলে কেউ ঠাট্টা করে? মায়ের চোখের সামনে সন্তান হারিয়ে যাওয়া যে কতটা কষ্টের, তা কেবল মায়েরাই বোঝে। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর জমে আছে..., মিনি সেটাকে ছেড়ে দিয়ে হালকা হওয়ার চেষ্টা করল।
স্কুলের ঘণ্টা পড়তেই সে বাসে ওঠার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। রোজ বাসে চড়ে এভাবে মেয়ে দুটোকে আনা–নেওয়া করতে মিনির ভালো লাগে না। তা ছাড়া ওরাও বড় হচ্ছে।
শাহেদের ব্যবসাটা ভালো করে দাঁড়িয়ে গেলেই একটা গাড়ি কিনবে ওরা। এ বছরের শেষ দিকে ব্যাংক লোন পাওয়া যাবে। আর তো কটা মাস, তারপর শান্তিতে যাতায়াত করা যাবে। বাসে নোংরা লোকদের বাজে চাহনি আর ইচ্ছা করে গায়ে ধাক্কা খাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে লোকগুলোকে কষে থাপ্পড় লাগাই, যেন আর কখনো এমন নোংরা চোখে না তাকায়। ভীষণ রাগ হয়, কোনো উপায়ও নেই। মেয়ে দুটো সঙ্গে থাকে বলে রাগ সামলিয়ে নেওয়া যায়।

কলেজে পড়ার সময়কার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল মিনির। বাসের কন্ট্রাক্টর ‘আফা, সাবধানে নাইমেন’ বলে অযথাই হাতটা ধরে নামানোর চেষ্টা করায় শার্টের কলারটা ধরে ওর গালে থাপ্পড় মেরেছিলাম। ওই বেটার সারা জীবনেও ভোলার কথা নয়।
মিনি এক এক করে লিস্ট মিলিয়ে কেনাকাটা করছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। এখন যাওয়া দরকার। হঠাৎ মনে পড়ল আফ্রা রাতে কমলা চেয়েছিল, কিন্তু বাসায় ছিল না। সে হন্তদন্ত হয়ে কমলা কেনার জন্য এগোচ্ছে। ছুটি হওয়ার আগেই পৌঁছাতে হবে। দরদাম না করেই দোকানদার যা চেয়েছে, তা দিয়ে এক ডজন কমলা কিনে বাসে উঠে বসল। ছুটির পাঁচ মিনিট বাকি থাকতেই স্কুলে এসে পৌঁছে গেল। মেয়েদের বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি।
নোভা মাকে দেখে দৌড়ে এসে জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখতে চাইল। মিনি বারণ করল।
—বাসায় গিয়ে দেখ, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। রান্না করা হয়নি আজ, গিয়ে খাবে না?
রেডিও কলোনির সামনে বাস থামতেই তিনজনেই নামল।
—মা, আজ আমার হাতটা ধরবে কেমন করে?
—আমার হাতে অনেক বাজার। নোভার হাত ধর। তারপর আমার সঙ্গে পার হও।
তিনজনই এগোচ্ছে, পথিমধ্যে আফ্রার স্কেলটি পড়ে যাওয়ায় নুয়ে নিতে গিয়ে পেছনে পড়ে গেল সে।
হঠাৎ একটা শব্দ হলো। ততক্ষণে মাথার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া বাসটি শোঁ শোঁ শব্দ করে দূরে হারিয়ে গেল। আফ্রা নাই হয়ে গেল চোখের সামনে। হাতটা আর ধরা হয়নি!