মানবিকতা ও সুখ

অলংকরণ: স্বপন চারুশি

সুখের জন্য আমরা কত কিছু করি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, আমরা সুখের জন্য প্রেম চাই, কিন্তু সুখ মেলে না। কেউ বলে ভোগ নয়, ত্যাগেই সুখ। অনেকের মতে, সুখ ভোগেরই বিষয়। ব্যক্তিজীবনে আমার মনে হয়, প্রেম, ভোগ, ত্যাগ যা–ই বলি না কেন, মানবিকতার মধ্যেই সুখ।

মানবিক আচরণ মানুষের কাছ থেকেই আসে। মানুষই আবার অমানবিক আচরণ করে। ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের আচরণ অমানবিকতার গণ্ডি পেরিয়ে পশুদের মতো আচরণেও পরিণত হয়। মানুষই সে আচরণকে পাশবিক আচরণ বলে থাকে। তবে যা–ই বলি না কেন, অমানবিকতা, পাশবিকতা এসব আচরণে কখনোই সুখ পাওয়া যায় না। মানবিক আচরণের মাধ্যমে সুখ খুঁজে নেওয়া এ রকম কিছু সাম্প্রতিক ঘটনা এবং দেশ–বিদেশে অবস্থানকালীন কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করব আজকের লেখায়।

এক

ঢাকা শহরে বেওয়ারিশ কুকুর এক সমস্যাই বটে। কুকুর খুব প্রভুভক্ত ও বিশ্বাসী প্রাণী। গ্রামগঞ্জ, মফস্বল শহর, বড় শহর—সব জায়গাতেই কুকুরের উপস্থিতি লক্ষণীয়। মূলত খাদ্যের সন্ধানে কুকুরেরা ঘেউ ঘেউ করে, কারও পিছে ছোটে, এদিক–ওদিক ঘোরাফেরা করে। প্রাণী হিসেবে তারা বংশ বিস্তার করে, তাদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান, সেটাও লক্ষণীয়। অতীতে গ্রামে দেখা যেত প্রায় প্রতি বাড়িতেই পোষা কুকুর, পোষা বিড়াল। ফেলে দেওয়া হাড়, হাড্ডি প্রভৃতি খেয়ে ওরা বেঁচে থাকত, এখনো হয়তো বেঁচে আছে।

শহরে বিশেষত বড় শহরগুলোতে কুকুরের বেঁচে থাকা বেশ সংগ্রামের। এখানে বাসাবাড়িতে কুকুর পোষা খুবই কঠিন। শখের বশে কোনো বাড়িওয়ালা হয়তো কুকুর পোষেন, পুষতে পারেন। ভাড়া করা বাড়ি, বাসা বা ফ্ল্যাটে কোনো ভাড়াটিয়ার পক্ষে কুকুর পোষা বড় বিলাসিতাই মনে হয়, অসম্ভবই বটে।

ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে কুকুর তাই বেওয়ারিশ। মূলত নিম্নমানের হোটেল, রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি জনসমাগম হয়, এ রকম স্থান যেমন পার্ক, শপিং মল, বন্দর প্রভৃতি জায়গায় কুকুরের উপস্থিতি বেশি। হোটেল, রেস্টুরেন্ট আর মানুষের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়েই শহরের কুকুরেরা বাঁচে। শহরের উন্মুক্ত ভাগাড়গুলো থেকেও কুকুর খাদ্য গ্রহণ করে।

উন্নত রাষ্ট্রে বেওয়ারিশ কুকুর একেবারেরই বেমানান। সেসব দেশে কুকুর অনেক উন্নত জীবন ধারণ করে। কুকুর সত্যিকার অর্থেই সেখানে পোষা প্রাণী। যারা কুকুর পোষেন, তাঁরা তাঁদের এই পোষা প্রাণীর জন্য রীতিমতো খরচ করেন। সেসব দেশে সাধারণ থেকে শুরু করে উন্নত শপিং মল, সব জায়গায় মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি কুকুর তথা পোষা প্রাণীদের সব সামগ্রীর সরবরাহ আছে। অনুন্নত অনেক দেশে যেখানে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দুরূহ, অনিশ্চিত, সেখানে উন্নত দেশসমূহে পোষা প্রাণী তথা কুকুর–বিড়ালের জন্য রয়েছে ডাক্তার, রয়েছে আধুনিক সুবিধা সংবলিত হাসপাতাল। উন্নত দেশে অবশ্য পোষা কুকুর থেকে বিনিময়ও পাওয়া যায়। হাঁটার সময় কুকুরকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া থেকে বাড়ি পাহারা প্রভৃতি সুবিধা পাওয়া যায়।

আমাদের দেশে, বিশেষত ঢাকা শহরে সম্প্রতি কুকুর অজ্ঞান করে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সিটি করপোরেশন তাদের নিজেদের উদ্যোগে কাজটি করছে। মিডিয়ার কল্যাণে তা অনেক জায়গায় প্রচার ও প্রকাশিত হচ্ছে। এ রকম একটি যজ্ঞ সম্প্রতি অবলোকিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে। সিটি করপোরেশনের লোকজন প্রশিক্ষিত পদ্ধতিতে কুকুর ধরে ট্রাকে ভরছেন, ইনজেকশন পুশ করছেন, সংবাদ সংগ্রহকারী ব্যক্তিরা সংবাদ সংগ্রহ ও ছবি তুলছেন। আর একদল ছেলেমেয়ে এর প্রতিবাদ করছেন। প্রতিবাদকারী ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগই উঠতি বয়সী, তরুণ তরুণী, যুবা-যুবতী। তাঁরা বলছেন কুকুরের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে। আচ্ছা, এসব অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ করে প্রতিবাদকারীরা কী পাচ্ছেন? আমার মনে হয়, ওনারা সুখ পাচ্ছেন। ওনাদের দাবি, কুকুর ধরায় অমানবিক আচরণ পরিহার করা উচিত। কারণ মানবিক আচরণেই যে সুখ!

দুই

২০১৪ সালের কথা। জাপানে পড়তে গিয়েছি। অর্থনীতিতে পিএইচডি করছি জাপান সরকারের মনবুকাগাকুশো বৃত্তি নিয়ে। ওরা একজনের থাকা–খাওয়ার জন্য পরিমাণমতো বৃত্তি দিয়ে থাকে। আমি পরিবার নিয়ে সেখানে থাকি। ভালো গবেষণা ও থিসিস লেখার জন্য একটু আর্থিক টানাপোড়েন থাকলেও খণ্ডকালীন কোনো চাকরি করি না। একটু কষ্ট করে শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে কিছুটা দূরে বাসা নিয়ে থাকি। নিজের গাড়ি থাকায় সময় ধরে চলতে তেমন কষ্ট হতো না।

একদিন বরফ পড়া সকালে হাঁটতে বের হয়েছি। খুব ঠান্ডা আর বরফ পড়া রাস্তা কিন্তু চকচকে রোদ বিধায় লোভ সামলাতে পারিনি। মর্নিং ওয়াক শেষে পাহাড়ি রাস্তায় বাসায় ফিরছি, কিন্তু মনুষ্য গোঙানির শব্দে তাকাতেই দেখি, এক বৃদ্ধা বরফের ভেতর পড়ে গেছেন, লাঠি ভর দিয়েও উঠতে পারছেন না। দৌড়ে গেলাম, পরম যত্নে টেনে তুললাম সেই বৃদ্ধা জাপানি মহিলাকে। জাপানিরা খুব রিজার্ভ, তা জানা সত্ত্বেও সেই অসহায় বৃদ্ধাকে হাত ধরে সমতল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলাম। জাপান আমার স্মৃতিবিজড়িত দেশ। অনেক কিছু শিখেছি, অনেক কিছু পেয়েছি ওখান থেকে। কিন্তু আমার অন্যতম সুখের মুহূর্ত ছিল সেই অশীতিপর বৃদ্ধাকে ন্যূনতম সহযোগিতার মানবিক আচরণের মুহূর্তটি।

তিন

সময়কাল ২০০০ সাল হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি কোর্সে প্রেজেন্টেশন বাধ্যতামূলক। প্রেজেন্টেশনের জন্য অনেক প্রস্তুতি নিতে হয়, টার্ম পেপার রেডি করা, স্লাইড বানানো, প্রিন্ট করা, বাঁধাই প্রভৃতি তো আছেই, সাথে ভালো পোশাক পরে আসতে হয়, আমাদেরও আসতে হতো। শিক্ষকেরা প্রেজেন্টেশনে মেয়েদের শাড়ি আর ছেলেদের টাই, স্যুট বাধ্যতামূলক না করলেও পছন্দ করতেন। এখনকার ছাত্রছাত্রীদের মতো আমরাও আমাদের সম্মানিত শিক্ষক–শিক্ষিকাদের পছন্দকে সমীহ করতাম। সেমিস্টার সিস্টেমে খুব দ্রুতই কোর্স শেষ হতো এবং ঘন ঘন প্রেজেন্টেশন এসে যেত। মনে পড়ে, আমি এলিফ্যান্ট রোড থেকে রেডিমেড স্যুটকোট কিনেছিলাম মূলত প্রেজেন্টেশনকে উপলক্ষ করেই। বলতে দ্বিধা নেই, ২০০০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেজেন্টেশনের জন্য কেনা স্যুট কোটই আমার প্রথম স্যুটকোট। খুব যত্ন করে রাখতাম। এক প্রেজেন্টেশন শেষ হলে ড্রাই ওয়াশ করে রেখে দিতাম পরবর্তী সেমিস্টারের প্রেজেন্টেশনে ব্যবহারের জন্য। তো একদিন কোনো এক কোর্সের প্রেজেন্টেশন বেশ দেরিতে শেষ হলো। সন্ধ্যা হয় হয়। মল চত্বর পেরিয়ে আইইআরের সামনের রাস্তা ধরে হলের দিকে যাচ্ছিলাম। সঙ্গে আমার প্রেজেন্টেশন গ্রুপের কয়েক বন্ধু। হাঁটতে হাঁটতে এক করুণ দৃশ্য দেখে চোখ আটকে গেল। এক ছোট্ট দুধের শিশু কাঁদছে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে। পাশে তার চেয়ে একটু বড় ভাই ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে। মা নির্ঘাত ওদের সেখানে রেখে খাবার সংগ্রহে গেছে। কাল বিলম্ব না করে কোলে তুলে নিয়েছিলাম ধূলিমাখা ছোট্ট শিশুটিকে। ভুলে গিয়েছিলাম স্যুটকোট না কী পরে আছি। বন্ধুদের কেউ কেউ বলেছিল, স্যুটকোটে ধূলি লাগার কথা। কিন্তু ছোট্ট সে শিশুর কান্না থামনোই ছিল ওই সময়ের জন্য আমার প্রধান কাজ। কান্না থেমেছিল, হোক সে দুদণ্ডের জন্য। কিন্তু সে সুখ, সে আমার সারা জীবনের সুখ! দেশে–বিদেশে কত কত সভা, সেমিনার, সমাবেশ, ক্লাস; কত জায়গায় কত স্যুটকোট পরে যাই। কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করে, স্যুটকোট পরে সবচেয়ে সুখের মুহূর্ত, তবে সেটা মল চত্বরের সেই শিশুটিকে কোলে নেওয়ার মুহূর্তই বটে!

চার

ঢাকা শহরে জীবনধারণ সবার জন্যই বেশ কঠিন। কোনো কিছুই খুব সহজলভ্য নয়। বাজার করা থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতে কাজের লোক পাওয়া—সবকিছুতেই অল্পবিস্তর সমস্যা আছেই। পরিবারের সবাই বেড়াতে গেছে, নানা জটিলতায় আমার যাওয়া হয়নি। বাসায় কাজের বুয়া নেই। এক বন্ধু সহযোগিতা করতে এগিয়ে এল। অনলাইনে কাজের বুয়ার অর্ডার দিয়ে দিল। যথারীতি কোম্পানি থেকে কনফার্ম করল। নির্ধারিত সময়মতো কাজের বুয়া হাজির। কিছুটা ইতস্তত করে সে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করা শুরু করল। দুপুরে এসেছে তাই বললাম দুপুরের খাবার খেয়ে যেতে। প্রথমে ইতস্তত করলেও পড়ে রাজি হলো। কাজ শেষ করলে মেয়েটিকে বললাম, সে মাছ না গোশত খাবে। আমার সঙ্গেই ডাইনিং টেবিলে বসতে বললাম। সে খেতে খেতে তার কথা বলে চলল। চার বছরের শিশুপুত্র নিয়ে সে একা থাকে। বিয়ের দুই বছরের মাথায় বিবাহবিচ্ছেদ। নেশাখোর স্বামী, বেশির ভাগ সময় জেলহাজতে থাকত। অত্যাচার করত। বিরক্ত হয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে বেঁচে আছে। এখন সে কোম্পানিতে বুয়ার চাকরি নিয়ে হলেও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে আছে। সে তার ছেলেকে স্কুলে দিতে চায়, মানুষ করতে চায়।

আমি তাকে আশীর্বাদ করলাম, তার ছেলের জন্য শুভকামনা। তাকে তার মজুরি দিয়ে বিদায় দিলাম। ছলছল চোখে সে বলল, আমি যেন মনে কিছু না করি। বললাম কেন? কিসের জন্য মনে কিছু করব? সে বলল, ‘চারদিকে খারাপ আচরণ পেতে পেতে ভালো ব্যবহার কী, তা ভুলেই গিয়েছিলাম।’ তার মতে, ‘আমাকে দেখে তার আস্থা আর ভালো ব্যবহারের কথা মনে পড়ল।’ মেয়েটি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। ওর চোখের জলে আমার খুব সুখ লাগল!

কী করেছি আমি? বললাম, আমি মানুষ, মানবিক আচরণই তো আমার কাছে কাম্য। পাশবিক আচরণ যারা করে, তারা পশু। বনে জঙ্গলে থাকা উচিত তাদের বাসস্থান। লোভ–লালসা নয়, সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকানো, পাশে বসিয়ে একটু খাবার দেওয়া, আর ন্যূনতম ধৈর্য নিয়ে তার একটু কথা শোনা। এতটুকু মানবিক আচরণেই এত এত সুখ। বলি, মানবিক আচরণে, মানবিকতায়ই সুখ।

সহযোগী অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়