আমাদের মধ্যে একটা পাগলামি আছে। মা–বাবা–আমি মিলে বিকেলে মোটরসাইকেলে করে দিনাজপুরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াই। আমার শহরটা যে এত সুন্দর আর বড়, আগে জানতাম না। গত পরশু আমরা গিয়েছিলাম বনতারার নদী দেখতে। জানি না জায়গাটার সঙ্গে আমাদের আর বৃষ্টির কী শত্রুতা আছে। ওখানে গেলে মাঝপথে এমন বৃষ্টি নামবে যে আর ঘোরা হবে না। সেদিনও খুব বৃষ্টি। মোহনপুর পার হয়ে বনতারার রাস্তায় কিছু দূর যেতেই বৃষ্টির কারণে একটা টিনের চালওয়ালা দোকানের নিচে দাঁড়ালাম। একজন বৃদ্ধ মহিলা আগেই বসেছিলেন সেখানে। একটা ছেলে মোবাইলের ছোট স্ক্রিনে চোখ দিয়ে বসে আছে। তার পাশে পায়ের বৃদ্ধাঙুলে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা পা নিয়ে বসে আছেন মধ্যবয়স্ক এক লোক। তাঁর কাছে ছুটে এল একটা ছোট মেয়ে, বয়স হয়তো পাঁচ-ছয়। তাই অগত্যা আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়েটির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাইতেই তিনজন ভ্যানচালক এসে দাঁড়াল। আমি একটা ডালমুটের প্যাকেট কিনে খেতে লাগলাম। মেয়েটা ছিল তিনজনের ওই পাশে। তাই ওকে কাছে পেলাম না। দ্বিতীয় দফায় আরেকটা প্যাকেট কিনে মায়ের হাতে দিয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে হাঁসদের বৃষ্টিবিলাস দেখছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম মেয়েটি আমার পাশে একটা বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরও যে মানসম্মান আছে এবং দোকানের পাশে থাকলে ও কিছু কিনে খায়, তা বোঝাতেই হয়তো আমার পাশে এসে দাঁড়াল।
নাম ওর মেঘ। কী অদ্ভুত। আকাশে এক মেঘদম্পতি ঝগড়া করছে আর তাদের ছোট মেয়েটাই বুঝি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো, ভালো একটা বন্ধুত্বও হলো। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দুপুরে কী খেয়েছ?’ বলল, ‘পান্তা’।
আমি বললাম, ‘আর?’
ও বলল, ‘পেয়াঁজ।’
আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আর?’ ও বলল, ‘আর ফির কী? নুন দিয়া মাখি দিছোল আম্মু।’
আমি বললাম, ‘বাহ্, আমাকে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবে? আমিও পান্তা খাইতাম।’
সে বলল, ‘তুমি পান্তা খাও?’
এইভাবে কিছুক্ষণ কথা চলার পর আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, আমি ওর কাছ থেকে আর আর করে কী শুনতে চাচ্ছিলাম? মাছ, মাংস কিংবা অন্য কোনো তরকারি? শুধু পান্তা যে মানুষ খেতে পারে, এটা কি আমাদের বিলাসী জীবন ভুলিয়ে দিয়েছে? নাকি কোনো ফুটফুটে মেঘের এমন খাদ্যাভ্যাস সচরাচর আমরা কল্পনা করতে পারি না? হয়তোবা সচরাচর জীবনে ঘটে যাওয়া জিনিসগুলো আমরা খেয়াল করতে ভুলে গেছি।
ওপরে মেঘদম্পতির ঝগড়া কিছুটা কমলেও অভিমানী গিন্নি মেঘটির অভিমান সহজে কমার নয়। সে এখন মুখ ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে। তাই আমরাও বৃষ্টিতে ভিজে রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর সেই মানবমেঘ ছুটে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চলে গেল।