মা, নীলা আপার কী হয়েছিল?

প্রতীকী
ফাইল ছবি

স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স তখন মাস তিনেক। আমি পোড়োবাড়িটার পাশ দিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পরিচিত একটা মিষ্টি কণ্ঠ নাম ধরে ডাকল, ইরেশ...।

আমি চমকে পেছনে তাকালাম। দেখি নীলা আপা, অনেক দূর থেকে আমাকে ডাকছে। যদিও মনে হয়েছিল, ডাকটা খুব কাছ থেকে আসছিল। আমি থমকে দাঁড়ালাম। আমার শরীর শিউরে উঠল। একটা ভয়ের স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে দ্রুত নিচে নেমে গেল। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া নীলা আপার শাড়ি উড়িয়ে নিয়ে গেল। কিছু শকুন নীলা আপার মাথার ওপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে। আমি দ্রুত চোখ বন্ধ করলাম। চোখ খুলে তাকানোর পর আমি নীলা আপাকে দেখতে পেলাম না।

চারদিকে যুদ্ধের ডামাডোল। নারীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন। বয়স কম হলেও কিছু কিছু বুঝতে পারি। কিন্তু কোনো কিছুই পরিষ্কার নয়। ভয়, সংকোচ আর লজ্জায় মাকেও জিজ্ঞাসা করতে পারি না। অনেক দিন ভেবেছি মাকে জিজ্ঞাসা করব, মা, নীলা আপার কী হয়েছিল? কিন্তু পারিনি।

পোড়াবাড়িটায় নীলা আপার সঙ্গে আরও প্রায় ১০০ মেয়েকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তাদের কারও কারও লাশ পাওয়া গেছে, কারওটা যায়নি। কারও কারও লাশ ছিল ক্ষতবিক্ষত, কারও বীভৎস৷ বাচ্চাদের সেসব লাশ দেখতে দেওয়া হয়নি। শুধু মুখে মুখে শুনেছিলাম। প্রিয় হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া নীলা আপার লাশ আমি দেখতে পারিনি। যাদের লাশ পাওয়া গিয়েছিল, তাদের সবাইকে এক কবরে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল।

পরপর তিন দিন পোড়াবাড়িটার পথে আমার সঙ্গে একই ঘটনা ঘটল। শেষবার আমি খুব ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফেরার পর প্রচণ্ড জ্বরে মরার মতো হয়ে গেলাম। টানা সাত দিন আমি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রইলাম। জ্বর কিছুটা ভালো হওয়ার পর মায়ের মুখে জানতে পারলাম জ্বরের ঘোরে সাত দিন ধরে মাকে শুধু একটা কথাই বলেছি, মা, নীলা আপার কী হয়েছিল? মা, নীলা আপার কী হয়েছিল?