ভূতের পাঁচালি

ভূতের পাঁচালিঅলংকরণ: মামুন হোসাইন

‘কয় দিন ধইরা আবার জিনিসটা ফিরা আইছে। যারে সামনে পাইতাছে তারেঐ নাকি জ্বালাইতাছে।’ চায়ের কাপে চামচ দিয়ে টুংটাং শব্দ করতে করতে কথাগুলো বলল কাসেম আলী। তালতলী বাজারের সবজিপট্টির শেষ মাথায় তার দোকান। সকাল থেকেই বাজারের লোকজন তার দোকানে চা–নাশতা করতে আসে। ভিড় লেগেই থাকে। কথাটা শুনেই সবাই তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বাকি গল্পটুকু শোনার জন্য সবার মন আঁকুপাঁকু করছে। পিরিচে ঠোঁট রেখে চায়ে দীর্ঘ এক চুমুক দিয়ে ফজর আলী জিজ্ঞেস করল, ‘কি রে কাসু, আবার কি অইলো? কেডা আইলো? খুইল্লা ক দেহি।’ একমনে কাসেম চুলায় কাঠের টুকরা দিচ্ছে। চুলার আগুনটাকে উসকে দিয়ে বলল, ‘কেরে? কিছু মনে হয় হুনো নাই, ফজর আলী ভাই?’ দোকানে সুনসান নীরবতা নেমে এল। সবাই কানটা পেতে রাখল কাসেমের ঠোঁটের দিকে। কথাটা শোনার কৌতূহলে কারও কারও আঙুলেই বিড়ি পুড়ছে, কারও কারও গরম চায়ের কাপেও নেমে এসেছে হিমালয়ের বরফ শীতলতা!

হারান মাঝি অধৈর্য হয়ে ধমকের স্বরেই বলল, ‘কাসু, এইডা তোর বদভ্যাস। গল্প শুরু কইরা জিরাইয়া জিরাইয়া কতা কছ। তাড়াতাড়ি ক তো দেহি কী অইছে? নাইলে আমি ঘাটে যাই।’ এবার বিরক্তি নিয়ে কাসেম হারান মাঝির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধুর মিয়া, বহো। কইতাছি।’ এবার সবাই আড়মোড়া দিয়ে বসল। ‘গতকাইল রাইতে রমিজ মিয়ারে ভূতে ধরছিল। ভোর রাইতে আজানের সময় আমি পিশাব করতে বাইর হইছিলাম। করুণ একটা গোঙানির শব্দ হুইন্না ভয় পাইয়া গেছিলাম। দৌড়াইয়া কুনুরহম জানডা লইয়া ঘরে গিয়া পড়ছি। তোমগো বউয়ের চিৎকার হুইন্না বাড়ির বেকতে উইঠ্যা পড়ল। পরে সবার সাথে আমিও কুপিবাতিডা লইয়া সামনে গিয়া দেহি ছাইয়ের পাড়াত রমিজ মিয়া চিত হইয়া পইড়া আছে। বেঘোরে গোঙাইতাছে। কী যে ভয়ংকর দৃশ্য! সারা রাইত মনে হয় জিনিসটার লগে ভালোই ধস্তাধস্তি করছে। রমিজ মিয়ার নাকে–মুখে দেখি লোল বিজলা বাইর হইয়া গেছে। শইল্লের মইধ্যে কালচা দাগ। আজান না পড়লে মনে লয় মাইরাই ফালাইত। আল্লায় বড়ই বাঁচান বাঁচাইছে রমিজরে’—একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে একটু থামে কাসেম।

রাজমিস্ত্রি আবুল বেঞ্চ থেকে পা নামিয়ে বলল, ‘গত পোরকা নাকি পুবপাড়ার কলিমুল্লা চাচারেও রাইতে আটকাইছিল। এক পা–ও নাকি গাবগাছটার আগায়, আরেক পাও নাকি মাটিত আছিল। কল্লিমুল্লা চাচারে কইছিল ঠ্যাংয়ের নিচে দিয়া যাইতে। কলিমুল্লা চাচায়ও তো কম জানা লোক না! সুরা–কেরাত পইড়া ফুঁ দিছে পরে নাকি তারে ছাড়ছে।’
‘হ, গেল বছর ছনু পাগলা ট্রাক অ্যাকসিডিন্টে মরার পরেত্তে এই জায়গাডা দূষিত হইয়া গেছে। কবিরের মুরগির ফারোমের পর থেইক্কা ছনু পাগলার কবর পর্যন্ত কি ঘুটঘুইট্টা আন্ধাইর রে বাবা! গাবগাছের তলাটা আরও ভয়ংকর। দিনের বেলায়ও যাইতে গাও কাঁটা দিয়া উঠে। হুনছি অ্যাকসিডিন্টে মানুষ মরলে নাকি ভূত হইয়া আহে। ছনু মিয়া তাইলে হাচাঐ ভূত হইয়া গেছে’—হারান মাঝিও গল্পে শরিক হয়। এবার ফজর আলী সবাইকে চুপ থাকার নির্দেশ দেয় এবং রমিজ মিয়ার সর্বশেষ খবর জানতে চায়। এমন সময় কাসেমের দোকানে আসেন মেম্বার সাহেব। চেয়ার টেনে বসতে বসতে তিনি বললেন, ‘রমিজ মিয়ার অবস্থা খুব একটা ভালা না। রমিজরে পানিতে বরইপাতা, নিমপাতা দিয়া গরম পানি দিয়া গোছল করাইছে। দাওয়ের আগাত নুন লইয়াও খাওইছে। তবুও তার রাইতের ব্যাপারটা যাইতাছে না। খালি কয় পাঁচটা পোলা নাকি তারে মারছে। ছায়ার মতোন নাকি পোলাগুলা আইয়া খুব জোরে জোরে মারছে! কও তো দেহি বেকতে কয় তারে ভূতে ধরছে।’ হারান মাঝি গলাটা একটু উঁচু করে বলল, ‘মেম্বার সাব, গতকাইল রাইতে তো রমিজ মিয়ারে আমি নদী পার করছি। মাউরা বাইত গিয়া মনে হয় খুব বেশি মাল খাইছিল। হাতেও একটা বোতল আছিল।’