ভালোবাসার গন্ধ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নিশিরাত। অর্ধচাঁদ আকাশের সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ঝিঁঝি পোকা এক নিয়ম মেনে সুরে সুরে ডেকে যাচ্ছে। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়ে জোছনার আলো নুরুনের চোখে এসে পড়ছে। বাইরের হিমশীতল ঠান্ডা বাতাস শরীরে এসে লাগছে, সাথে সাথে শরীরে পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে তার। এই মাঘ মাসের শীতে ঘরে কিছু নেই যে গায়ে দেবে। ছেঁড়া শাড়ির আঁচল দিয়ে কোনোমতে শরীর ঢাকার বৃথা চেষ্টা করছে নুরুন। পেটের ভেতর মনে হচ্ছে, আগুন লেগে গেছে। ব্যথায় কাঁকড়ার মতো হয়ে গেছে সে। আজ সারা দিন কোনো দানা পড়েনি পেটে।

গরিবের ঘরে জন্ম নুরুনের। বয়স যখন ১০, তখন বাবা মারা যায় যক্ষ্মায়। মা তো ছোটবেলায় সবার আগে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। বৃদ্ধ নানি আর সে একটি খুপরিঘরে বসবাস করে। মানুষের ঘরে কাজ করে কোনোমতে সংসার চলে তাদের। আজ কয়েক দিন ধরে কোনো কাজ নেই হাতে। বলতে গেলে এই কদিন তারা না খেয়ে আছে। যার-তার ঘরে কাজে যেতে পারে না সে। ভরা যৌবন শাড়ি দিয়ে ঢাকা কি এত সহজ?

সেদিন বুড়ো আনাই মিয়া বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিল তার নানির কাছে। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে বুড়ো, তা–ও যেন বিয়ের শখ মিটছে না। নানিবাড়িতে এসে বলে, ‘তোর লাইগা বিয়ার সম্বন্ধ লইয়া আইছি।’

নরুনের মুখ কালো হয়ে যায়। আষাঢ় মাসে কালো মেঘ যেমন আকাশকে ঢেকে রাখে, তার মুখেও সেই একই চিত্র ফুটে ওঠে। কারণ, তার তো নিজের বলে কেউ একজন আছে, নাম তার মতিন। সে–ও তো নুরুনের মতো গরিব। চালচুলা কিছুই নাই তার, আছে শুধু সুঠাম দেহ আর কালো দুই চোখ। যেই চোখে তাকালে নুরুন বোবা হয়ে যায়। মুখ দিয়ে কথা আসে না। নুরুন নানিকে উত্তর দেয়, ‘তুই গিয়া বিয়া ব, যা আমারে কস কে?’

নানি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘পোড়ামুখী তুই না খাইয়া মরবি, আমারেও মারবি। আনাই মিয়ার কিয়ের কমতি? খাওনদাওন সব তো ভালোই। বেটা মাইনষের বয়স আবার কিয়ের রে? যা মন চায় কর গা, তোর নাগর লইয়া বাইগা যা। আমি কইলাম গলায় দঁড়ি দিয়াম কাইলকা।’

এই বলে নানি চলে যায়। অনেক কষ্ট করে নিজের মনকে তৈরি করে নুরুন। পেটের জ্বালা আর তার সহ্য হচ্ছে না । হুট করে সে আনাই মিয়াকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তার কাছে পেটের ক্ষুধার চেয়ে বড় কিছু নেই এ পৃথিবীতে, হোক না সেটা ভালোবাসার কষ্ট।

মতিন হয়তো তাকে মাফ করবে না কোনো দিন। সব সুখ তো আর একসঙ্গে পাওয়া যায় না। ভালোবাসা ছেড়ে এসেছে পেটের জন্য। একটা হারালে কী হবে, অন্যদিকে তো সে সুখী। এই সব চিন্তা করে সে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়।

স্বামী আনাই মিয়ার শরীরে এক গন্ধ আছে, যা নুরুনের সহ্য হয় না। মনে হয়, সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। তার নানির শরীরেও ঠিক একই গন্ধ ছিল। শরীরের চামড়া শুকিয়ে যাওয়ার গন্ধ। ছোটবেলা থেকে এক গন্ধ নাকে লেগে আছে তার। কিন্তু মতিনের শরীরে এক মাতাল গন্ধ ছিল, যা তার শরীরকে কম্পিত করে দিত। মনে হতো, শিরায় শিরায় আগুন লেগে যাচ্ছে। একবার মতিন তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সে কী অনুভব, কী সুখ, কী আনন্দ! সেই সুখ আর সে পায় না খুঁজে।