বৃষ্টিদিনের গান

প্রতীকী ছবি। অলংকরণ: সোহাগ পারভেজ

এমন অনেক বৃষ্টিবিভোর রাত কেটেছে, আমি অপেক্ষায় থেকেছি আপনার সাথে বৃষ্টিবন্দনার কথা বলব বলে। অথচ তখন আপনি প্রতিষ্ঠিত যুবকের সাথে ভবিষ্যৎ মতাদর্শ নিয়ে ব্যস্ত। আমার কথা শোনার সময় তখন আপনার সময়ের চেয়ে অনেক দূরে। তবুও মনে হতো, এই বুঝি আপনার মতাদর্শন আলাপ শেষ হলো। হয়তো এক্ষুনি আমাকে রিং ব্যাক করবেন; তারপর কথা শুরু হবে।
কখনো এমনটি হয়ে উঠেনি। একদিকে আপনি এড়িয়ে যাচ্ছেন, অপর দিকে বৃষ্টি থামছেই না। রাত বাড়তে বাড়তে নিকটে চলে আসছে সকাল। কোথায় যেন পড়েছিলাম সাইকো, ভুবনেশ্বর বলেছিলেন, যে মুহূর্তে তুমি তোমার প্রিয়জনকে মনে করো, সেই মুহূর্তে সে–ও তোমাকে মনে করে, কিন্তু সেটা হয়তো সে সব সময় বলে উঠতে পারে না। এই সব ভুলভাল মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে মানুষ তার জীবনকে টেনে লম্বা করে দেয় আর মনে মনে সান্ত্বনা খোঁজে।
যখন আমি এভাবেই অপেক্ষায় বসে থাকি, রাত বাড়ে, বৃষ্টির তাণ্ডব বেড়ে চলে। তখন কোনো কোনো দিন ফোনে করাক-করাক রিং বেজে উঠে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে অপরিচিত একজন বলে ওঠেন, ‘এখনো জেগে আছেন?’
আমি তার পরিচয় জানতে চাই না, শুধু বলি, ‘আপনিও তো ঘুমাননি।’ সে হাসে, তার হাসি ছড়িয়ে পড়ে বৃষ্টির শব্দে। ভেসে যায় ঘর। আমার ঘর জুড়ে সে হাসির রেশ সুগন্ধির মতো ঘুরে বেড়ায়। আমিও মিথ্যে হেসে ওঠার ভান করি। সে বলে, ‘আপনার কুঁইকুঁই শব্দের হাসিটা বেশ অন্য রকম।’ কথা বলার মাঝখানে সে হাই তোলে, বলে, ‘ঘুম পাচ্ছে, আজ রাখি।’

আমি জানি সে রাখি বললেও ফোন কান থেকে সরাবে না। শুধু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবে। এরপর যখন আমি নিমিলিত কণ্ঠে হঠাৎ গুন গুন করে গাইব মান্ধাতা আমলের কোনো পুরোনো গানের লাইন, তখন সে বলবে, ‘আপনি গান খুব ভালোবাসেন, তাই না?’
আমার উত্তর শোনার আগেই সে আবার বলে উঠবে, ‘শুনেছি, যারা গান ভালোবাসে, তাদের মন অনেক শান্ত হয়; সত্যি কি তাই?’
আমি কথা এড়িয়ে গিয়ে বলব, ‘রাত অনেক হলো এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। বৃষ্টি থামবে না আজ। আমাকে যেতে হবে অনেক দূর, কোনো এক ঘুমের দেশে।’ এরপর, আমি ইচ্ছা করে ফোন রেখে দেব। আর কান পেতে শুনব ওদিকে তখনো চলছে ভবিষ্যতের মতাদর্শন পাঠ।
সাইকো, ভবানন্দ বলেছিলেন, ‘তুমি তাকে ভালোবেসো, যে তোমাকে ভালোবাসে আর যে তোমাকে ভালোবাসে না, তার কাছ থেকে দূরে থেকো।’ ভবানন্দর সব বক্তব্যের সাথে আমি কখনো একমত হই না, সব সময় দ্বিমত পোষণ করি।
মধ্যরাত শুরু হওয়ার একটু পরেই আপনার কথা বলা শেষ হয়। আপনি আমাকে ছোট্ট একটি এসএমএস করে জানিয়ে দেন, আজ মনটা খুব খারাপ, আপনার পক্ষে কথা বলা সম্ভব নয়।
ওদিকে তখন বৃষ্টির তাণ্ডব আরও বাড়তে থাকে। আমার ঘরের চারপাশে জমে যায় জল। আমার ইচ্ছে করে সেই জলে ডুবে বসে থাকি। কিন্তু সেটাও পারি না। কারণ, আপনার কাছ থেকে তিরস্কৃত হলে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। আমি তখন জানালা বন্ধ করে দিয়ে মোবাইল ফোন থেকে আপনার নম্বরটা ডিলিট করে দিই। মনে মনে একটু শান্তি অনুভব করি। কিন্তু আপনার সব তথ্য যে মাথায় জমে বসে আছে, তা মুছে দেব কী করে?