বিকেলের আলো

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একদিন দুপুরবেলা আমাদের বাড়ির উঠোনে একটা অদ্ভুত মানুষের ছায়া এসে পড়ল। গায়ে লম্বা ঢিলেঢালা জোব্বা। রংচঙে হলেও দেখলে জোব্বাটা যে কারোরই মনে হবে খুব পুরোনো আর ময়লা। বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছটায় একটু ছেঁড়া। উষ্কখুষ্ক চুল। আর চোখগুলো? অনেক লাল। এক্কেবারে সাক্ষাৎ লাল পিঁপড়ে যেন!

মানুষটাকে দেখে আমরা খুব অবাক হলাম। আমাদের বাড়িটা পুরোনো আমলের। নোনা ধরা দেয়াল। দেয়ালে শ্যাওলা। আমার দাদা কতকাল আগে যে বাড়িটি বানিয়েছিলেন! বাড়ির সামনে উঠোন। সেই উঠোনে আমরা গোল বার বানিয়ে বল খেলি। কখনো কখনো ক্রিকেটও।

মানুষটা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে তার ছায়াটাও।

আমরা দুপুরের খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম মানুষটার দিকে। বাবা আমাদের বললেন, ‘তোরা খাওয়া বন্ধ করে অমন করে তাকিয়ে আছিস ক্যান? ভাত খা।’

বাবার কথা শেষ হওয়ার আগে মা রান্নাঘর থেকে বলে উঠলেন, আজ দুপুরের পর যে অঙ্কের স্যার আসবে, সেদিকে খেয়াল আছে?

অজিত স্যারের কথা শুনে আমাদের টনক নড়ল। ওরে বাবা, যাকে বলে অজিত স্যার! অঙ্ক না পারলে স্যার পিঠের চামড়া তুলে নিয়ে নাগরা জুতা বানাবেন–আমার মেজো চাচা পড়া না পারলে সে রকম ইঙ্গিতই দিয়ে রেখেছেন স্যারকে। মানুষটা চোখ লাল করে আমাদের বলল, ‘বজলু কই?’

বজলু কই মানে!

মানুষটার কথা শুনে আমরা এ ওর দিকে, ও এর দিকে তাকাই। মানুষটার সাহস তো কম না!

বজলুর রহমান আমাদের বড় চাচা। যে বড় চাচার নাম শুনলে বাড়িসুদ্ধ লোকের কলজে কেঁপে ওঠে, সেই বড় চাচার নাম ধরে ডাকা? আর তা-ও কিনা ময়লা কাপড়ের জোব্বা পরা একজন মানুষ?

বাবা অবাক হয়ে উত্তর দিলেন, ‘বজলু সাহেবকে দিয়ে আপনার কী হবে?’

‘কী হবে মানে! ওকে পেলে এক থাপ্পড়ে ওর দুই মাড়ির সব দাঁত ফেলে দিতাম’ বলে মানুষটা বিড়বিড় করে কী যেন বলল।

আমাদের চোখ তখন প্রায় বেরিয়ে আসছে। আমাদের সামনে বাবার কথা প্রায় বন্ধ। বাবার চোখ তখন কপালে গিয়ে ঠেকেছে।

মা রান্নাঘর থেকে গলা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার, তোমরা এতক্ষণ ধরে কার সঙ্গে কথা বলছ? কে এসেছে?’

বাবা বললেন, ‘তুমি তোমার কাজ করো। সবদিকে কান দিয়ো না।’

বোঝা যাচ্ছে বাবার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। মেজাজ খারাপ না হয়ে যায়! নিজের বড় ভাইয়ের নাম ধরে ডাকাডাকি। তারপর আবার বলছে কিনা বজলুকে পেলে এক থাপ্পড়ে ওর সব দাঁত ফেলে দেবে? কী সাংঘাতিক ব্যাপার!

বাবা আমাদের মনোযোগ দিয়ে খেতে বলে মানুষটাকে বললেন,

‘বলেন তো আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’

‘সেটা জেনে তোমার লাভ কী?’ বলতে বলতে লোকটা উঠোনে বসে পড়লেন।

মানুষটার কথা শুনে মুহূর্তে আমাদের কান গরম হয়ে গেল। আমাদের খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের মধ্যে সন্দেহ ঘুরপাক খেতে লাগল, আচ্ছা, লোকটা পাগল না তো?

মানুষটা এবার উঠোনে বসে থেকে চোখ পিট পিট করে একটা অদ্ভুত মায়াময় দৃষ্টি আমার দিকে ছুড়ে মারলেন। আমার বুকের ভেতর ঝিম ধরে এল। আমার পাশে বসা মুন্নী, রুবা আর রিদ্য আমার দিকে তাকাল। রিদ্য বলল, ‘রিজ ভাইয়া, লোকটা তোমাকে দেখছে।’ তারপর মিনমিন করে রিদ্য বলল, ‘ভাইয়া, তোমার খবর আছে।’

‘রিদ্য আমারে এক গ্লাস পানি দেও তো। খুব তিয়াস পাইছে।’ বলে মানুষটা থির হয়ে রইল।

মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে আমাদের দেখলেন। তারপর উঠোনে বসে থাকা মানুষটাকে ভালো করে দেখলেন। দেখে চোখ বড় বড় করে মা বলে উঠলেন, ‘আসাদ ভাই না! এ কী হাল হয়েছে আপনার? কত দিন পর আমাদের বাসায় এলেন।’

মায়ের কথা শুনে বাবা কী অবাক, তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক আমরা। ‘আরে! আমাদের আসাদ চাচা, আর আমরাই চিনতে পারলাম না?’

এত বড় দাড়ি-গোঁফ রাখলে আসাদ ভাইকে কীভাবে চিনব?

মা বারান্দা থেকে উঠোনে নামতে নামতে বললেন, ‘চেনা বামনের পৈতা লাগে না।’

‘আমি ভাত খাব। আমার খুব খিদে লেগেছে।’ বলে মানুষটা চুপ মেরে গেলেন।

মানুষটা বিকেলের দিকে বিদায় নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে চলে গেলেন। শেষ বিকেলে আমাদের গলিতে মানুষটার দীর্ঘ ছায়া। মানুষটা যুদ্ধের সময় অকুতোভয়ে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধের সময় বউ, ছেলে, মেয়ে সবাই মারা গেলে মানুষটা আর নিজের ঘরে ফিরে যায়নি। যুদ্ধের পর মানুষটা করল কী, আর ঘরে থাকল না। সারা দেশ ঘুরে বেড়ায়। মানুষটা কেন সারা দেশ ঘুরে বেড়ায়? কেউ জিজ্ঞেস করলে মানুষটা জবাব দেয়, ‘সারা দেশে ঘুরি কেন? সারা দেশে ঘুরলে আমার পায়ে লেগে থাকবে দেশের মাটি। আর দেশের মাটিতে লেগে থাকবে আমার পদচিহ্ন।’

আমরা দেখি, বিকেলের আলোয় মানুষটার ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠেছে।