বাবা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কেউ বাবাকে তুলনা করে বটবৃক্ষের সঙ্গে, কেউবা আবার আকাশের বিশালতার সঙ্গে। বাবাকে নিয়ে গল্প, কবিতা, গান আরও কত কিছু লেখা হয়। ভালোবাসি মুখে না বলতে পারলেও সন্তানের কাছে বাবার ভালোবাসা অম্লান, চিরস্থায়ী, অক্ষয়। যখন তাকে নিয়ে লেখা গান শুনি, অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে।
বাবার স্মৃতি নিয়ে অনেকেই মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনায় লেখে, ছন্দ বানায়, গান গায়। আর আমার বাবা? আমিও লিখতে পারি টুকরা স্মৃতি। সেগুলো বড়ই অদ্ভুত। আমার বয়স যখন পাঁচ, সে সময় বাবার সঙ্গে স্মৃতি জোগানোর ইতি ঘটে। এই বয়সে বাবাকে কতটুকু চেনা যায় জানি না। সবার মতো বাবাকে নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখতে পারব না। তবে তাকে হারিয়ে বুঝেছি শূন্যতা কী।
তাই তো বাবা দিবস এলে আমার কাছে আনন্দের চেয়ে বেশি বিরহ অনুভব হয়। আমার বটবৃক্ষ নেই, আকাশের বিশালতা অনুভব করতে পারি না। অনুভূতির দরজায় বাবা শুধু কড়া নেড়ে গেছে। প্রবেশ করে তার মুখটা দেখাতে পারেনি। স্কুলে থাকতে অন্যদের বাবা যখন তাদের পৌঁছে দিত, আমি তখন চেয়ে চেয়ে দেখতাম। তবু কেন যেন নিজেকে অসহায় মনে হতো না। যত বড় হয়েছি, বুঝতে শিখেছি, শূন্যতা অনুভব করেছি।
ঝড়–বৃষ্টির ঝাপটায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছি বারবার, শুধু তুমি নেই বলে বাবা। কখনো মনের চাপা কষ্ট বুঝতে দিইনি কাউকে। ভয় হয় যদি মা কষ্ট পায়। আজ বুঝি বাবা ছাড়া একটা মেয়ে কতটা অসহায়। বাবার কাছে মেয়ে নাকি রাজকন্যা। আমি সেই ছোট্টবেলায় রাজাকে হারিয়েছি। রাজকন্যা হব কীভাবে। আমি না হয় সাধারণ মেয়ে হয়েই থাকতাম, তবু যদি তুমি থাকতে বাবা। আজ তুমি থাকলে সবকিছু অন্য রকম হতো।
আমি যখন প্রথমবার লিখতে শিখি। বাজারের লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছিলাম বাবার হাতে। চুড়ি, মালা, ক্লিপ এগুলো লেখা ছিল। সবাইকে খুশিমনে বলেছিলে আমার মেয়ে লেখা শিখেছে। তুমি জানো বাবা, তোমার মেয়ে আজ কত কিছু পারে? তোমার মেয়েকে একা কত কিছু করতে হয়? এখন আমের সময়। একটা স্মৃতি খুব করে মনে পড়ে। নিজের ভাগের সব আম শেষ করে তোমাদের ভাগের আম যখন খেতে গেছি, তুমি আমাকে মজা করে তাড়িয়ে ধরেছিলে। আমার সারা শরীর একবার বসন্ত রোগে ছেয়ে যায়। আমি প্রচুর দুষ্টামি করতাম বলে তুমি বলতে কোথায় মারব। মারার তো জায়গা নেই। তোমার শাসন খুব মিস করি বাবা। পায়ে মাটি লাগতে দিতে না। তুমি বাড়ির বাইরে বের হলেই আনন্দ হতো, সারা দিন ধুলাবালু দিয়ে খেলতাম। আমি তখন বুঝিনি, বুঝলে তোমাকে এত দূর চলে যেতে দিতাম না কখনো।
তুমি আমাকে সেই সুযোগ করে দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে। আমি চাই না এই সুযোগ। ছোট্ট বোনটা কেবল বুলি আওড়াত আব্বু! আব্বু! আজ বহু বছর হলো তোমাকে ডাকতে পারি না। মনটা কেমন ছটফট করে। বাবা দিবসে বাবা নিয়ে সবাই কত কিছু লেখে, আমি কী লিখব? আমার কেবল দুঃখের স্মৃতি। বাবা তোমাকে শেষ কবে ডেকেছি আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, আম্মুর কাছে এসে কাঁদছিলাম আর বলেছি, স্যাভলন দাও, ডেটল দাও, আব্বুর ঠোঁট কেটে গেছে। আম্মু বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিল। আমি তোমার কাটা ঠোঁট দেখলাম, মুখ দেখলাম, ঘামে ভেজা চুল কপালে আটকে ছিল তা দেখলাম। চারদিকে কান্নার রোল, তুমি নীরব নিশ্চুপ শুয়ে ছিলে। কী ভেবেছিলে তুমি পালিয়ে গেলে মেয়ে সুখে থাকবে? সবাই দলে দলে ভিড় করে দেখতে আসছিল, অবুঝ আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম কিসের এত আয়োজন। আমার আব্বু শুয়ে আছে কেন? কথা বলে না কেন? আব্বু ওঠো! আহা! অবুঝ আমি বুঝিনি আব্বু আর উঠবে না। আর বলবে না, ‘মা রে, আয়, আমার কাছে আয়।’ কাফনের কাপড় বারবার রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। গোসল করানো হলো। সেই চিরচেনা হাত বেয়ে পানি পড়ছিল, দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম কী করছে ওরা ওই কাপড়ের ভেতর আব্বুকে নিয়ে। আব্বুর শেষ গোসল! তখন বুঝিনি হায়! আমার জীবন থেকে আমি কী হারালাম। আব্বুকে আতর, গোলাপজল দিয়ে সাজানো হলো। সবাই কান্না করছে। আমি কেবল চেয়ে চেয়ে দেখছি। একদম শেষবিদায় পর্যন্ত। এই স্মৃতি কোনো মেয়ের জীবনে না আসুক। আমি চাই না এই স্মৃতি। আমি ভুলতেও পারি না। কী লিখব বাবাকে নিয়ে? বাবা মানে নিশ্বাস, প্রশ্বাস সবকিছু। দম বন্ধ লাগে মাঝেমধ্যে।
লেখা: কার্যকরী সদস্য, প্রথম আলো বন্ধুসভা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়