বাবার কথা

আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল। বয়স তখন সাত-আট হবে। প্রথমবার বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া। ছোট্ট ছাতার নিচে বাবা আর আমি। কিছু দূর যেতেই টের পেলাম বাবা ভিজে গেছেন, আমাকে ভিজতে দেননি। পায়ে কাদা লাগবে ভেবে কোলে করে স্কুল নিয়ে গেলেন। শিক্ষককক্ষে প্রবেশ করেই সালাম দিলাম। টিচার নাম জিজ্ঞেস করলেন, লিখতে বললেন। খাতায় লিখলাম। শুরু হলো ভর্তি পরীক্ষা, অ-অজগর, আ-আম, ই-ইলিশ, ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত বানান লিখলাম। সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে বাবা শিখিয়েছিলেন। সন্ধ্যা হলে বাবা আমাকে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসতেন। না পারলে বকুনিও দিতেন। বাজারে গেলে ছানার মিষ্টি আর সমুচা–জিলাপি খাওয়া আবশ্যক।

মা অসুস্থ হলে ওনাকে নানাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। ফুফু আমাকে দেখাশোনা করতেন। মা নানুবাড়িতে, বাবা কক্সবাজারে।

বাবা সাদাসিধে প্রকৃতির, কখনো বিলাসিতা করতে দেখিনি। সবার কাছে ছিলেন বিনয়ী, সৎ ও পরোপকারী ব্যক্তি। সব সময় মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতেন। নিজের স্বার্থের কথা কখনো ভাবতেন না। আত্মীয়দের কার কী সমস্যা আছে, বাবার কাছে এলে সমাধান। সবাইকে সহযোগিতা করতেন। বাবা সব সময় একটি কথাই বলেন, পরোপকারে সুখ।

একদিন বাবা অ্যাকসিডেন্ট করলেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। অস্ত্রোপচার করার প্রস্তুতি চলছিল। খুব কষ্ট হচ্ছিল বাবার জন্য। যদি কিছু হয়ে যায়। মাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিলাম, বললাম, কিছু হয়নি। বাবা ভালো হয়ে যাবেন। বৃষ্টিভেজা রাতে ক্লিনিকে বাবার সহকর্মীরা এসে ভিড় জমাচ্ছেন। রাত দুইটায় বাবার অপারেশন শেষ হলো। পরদিন ওনাকে বললাম, অফিসে আপনার এত জনপ্রিয়তা! জবাবে বললেন, ‘জীবনে উপকার ছাড়া কখনো মানুষের ক্ষতি করিনি। নিজে ঠকেছি, তবু কাউকে ঠকাইনি।’ বাবাকে বললাম, আপনার সহকর্মীরা ভিড় করেছেন মধ্যরাতে। চোখ ভেজালেন।

বাবা এখন সুস্থ। চাকরি থেকে অবসর নিলেও ঠিক আগের মতোই আছেন, একটু বদলাননি। বাবার আদরমাখা শাসন এখনো কমেনি। ওনার কাছে আমি এখনো ছোট। সব সময় খোঁজখবর নেন।

ঢাকায় আসার পর বাবাকে খুব মিস করি। ওনার একটাই কথা, যেন চিন্তা না করি। প্রকৃত মানুষ হতে, বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। অন্যের উপকার করার মধ্যে যে তৃপ্তি, সেটা কখনো টাকা দিয়ে কেনা যায় না।

বাবা, আমি আপনার সন্তান হতে পেরে ধন্য। বটবৃক্ষের মতো আজও ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছেন। ঋণ শোধ করার মতো সাধ্য পৃথিবীর কোনো সন্তানের নেই।

লেখক, সদস্য, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা