বাবার ঋণ

প্রতীকী ছবি
সংগৃহীত

চাকরিতে জয়েন করার পর বেশ ভালোই দিন কাটতে লাগল। পরিবারের যে অস্থিতিশীল অবস্থা, তা ধীরে ধীরে কেটে যেতে লাগল।

পড়ালেখা শেষ হবে কি হবে না, একসময় এটা নিয়ে খুব ভাবনায় ছিলাম। যেহেতু আমার পড়ালেখাটা ভালো ছিল। তাই বাবা বলতেন, আমি যেখান থেকে পারি, তোর খরচ চালিয়ে যাব। তুই শুধু ভালো করে পড়।

বাবা ছোটখাটো একটা চাকরি করতেন। এই শহরে বাড়িভাড়াতেই বাবার উপার্জনের অর্ধেক টাকা চলে যেত। বাকি টাকা দিয়ে সংসারের হাল বয়ে নিয়ে যেতেন তিনি একাই।

তিনি শেষ কবে ভালো জামাকাপড় পরেছেন, কে জানে। ঈদেও আমাদের আগে জামাকাপড় কিনে দিতেন। যখন বলতাম, ‘বাবা তুমি আর মা কখন কিনবে? ঈদ তো আর বেশি দিন নেই।’ বাবা বলতেন, ‘আরে লাগবে না আমাদের। আমার পুরোনো পাঞ্জাবি আছে না। এটা দিয়েই নামাজ পড়ে ফেলব। আর তোর মায়ের শাড়ি আছে, লাগবে না।’

বাবার পাঞ্জাবি আর আমার ছোট ভাইয়ের পাঞ্জাবি যখন ইস্তিরির দোকানে দিতাম তখন ইস্তিরির দোকানদার বাবার পাঞ্জাবি দেখিয়ে বলতেন, এই পাঞ্জাবি পুড়ে গেলে দায় নিতে পারব না। পাঞ্জাবি পাতলা হয়ে গেছে।

চাকরি পাওয়ার পর অনেক ভাবি সেদিনগুলার কথা। বাবা অনেক খুশি হলেন সেদিন, যেদিন আমি প্রথম চাকরির খবরটা বাবাকে ফোনে জানাই। সেদিন মনে হলো, বাবার মাথা থেকে একটা ভারী বোঝা হালকা হয়ে গেল। সেটা বাবার চোখে–মুখেও ধরা পড়ল।

আমি চাকরি পেলেও বাবা চাকরি ছাড়লেন না। যখন আমার চাকরিতে উন্নতি আর বেতন বৃদ্ধি পেতে লাগল, তখন বাবাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বললাম।

এ কথা শোনার পর বাবা একটা বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বললেন। বললেন, ‘আমি যদি চাকরি ছেড়ে দিই, তাহলে আমি যে পরিমাণ ধার করেছি, তা শেষ করতে তোর অনেক দিন লেগে যাবে। তোর বড় বোনের বিয়ে, তোর আর তোর ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ, সংসার চালানো—সব আমাকে একা সামলাতে হয়েছে। তাই আমি যত দিন আমার ধারের টাকা শোধরাতে না পারব, তত দিন আমি চাকরি করে যাব।’

তখন আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। তবে আমাকে বলতে পারো, তোমার কী পরিমাণ ধার রয়েছে।’ আমি তখন বাবার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। ধারের পরিমাণ অনেক।

ঠিক তখনি আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, বিয়েটা আরও পরে করব। যে টাকা আয় করি, সে টাকার যদি ৭০ শতাংশ বাবাকে দিতে পারি, আর বাকিটা দিয়ে আমি চলতে পারি। তাহলে বাবার ঋণ খুব তাড়াতাড়ি না হলেও তিন বছরে শেষ করা যাবে।

বাবা আমাদের জন্য পুরো জীবনটা কষ্টে কাটিয়েছেন। এই কয়টা বছর না হয় বাবার ঋণের টাকা শোধ করার জন্য নিজেকে একটু আরাম–আয়েশ কম দিয়ে, বাবার পাশে থাকতে পারি।

বাবা এখনো দামি জামাকাপড় পরতে চান না। এগুলো নাকি বিলাসিতা। যখন ভার্সিটিতে ছিলাম, মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে চলার পথে বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। কিন্তু বাবা তখন লজ্জা পেতেন। কারণ, ছেলেকে তখন তাঁর ভালো জামাকাপড় কিনে দেওয়ার সার্মথ্য নেই। অথচ ছেলের বন্ধুরা কত ভালো জামাকাপড় পরে আছে। অবশ্য তখন বাবার আক্ষেপ থাকলেও আমার এসব নিয়ে একবারেই তখন মাথাব্যথা ছিল না।

মা মাঝে মাঝে সংসারের দুঃখ আমাদের বলতেন, ‘বড় হও, সংসার কর। তারপর বুঝবে, একটা পরিবারের হাল ধরা কতটা কঠিন।’

এই মা–ই বাবাকে সাপোর্ট দিয়ে গেছেন সব সময়। না হলে একটা পরিবার চালানো কি সহজ হতো!

পণ করেছিলাম বাবার ঋণ শেষ না হলে বিয়ে করব না। বাসা থেকে সবাই আমার আর শায়লার কথা জানত। শায়লাকে আমার মা বেশ পছন্দ করতেন।

ভার্সিটিতে ঢোকার পরই তার সঙ্গে সম্পর্কের গোড়াপত্তন। তাকে যখন বললাম বাবার ঋণের কথা। তখন সে–ই হিসাব করে আমাকে বলল, যদি তোমার আয় থেকে ৭০ শতাংশ দিতে পারো বাবাকে, তাহলে তিন বছরে সব ঋণ শেষ হয়ে যাবে। আর আমি তো আছিই, সব সময় থাকব তোমার পাশে।

যেদিন সব ঋণ আমি আর বাবা মিলে শেষ করলাম, সেদিন বাবা অনেক স্বস্তি পেলেন। তখন বললেন, এবার তো বিয়েটা কর। শায়লারও তো বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। এবার মেয়েটাকে ‘বউমা’ বলার সুযোগ দে বাবা।

আমি তখন খুব অস্বস্তি নিয়ে বললাম, বাবা শায়লা অপেক্ষা করতে পারেনি আমার জন্য। তার পরিবার থেকে আমাকে বলেও ছিল, বিয়েটা করে ফেলতে। কিন্তু বাবা তখন আমি চিন্তা করেছি, তোমার সারা জীবনের কষ্টের কথা। অন্তত তোমার ঋণ শোধ করে, সে কষ্টটা কিছুটা হয়তো লাঘব করতে পেরেছি। আজ তোমার ঋণও শেষ হলো আর আগামীকালই তোমাকে চাকরি থেকে ইস্তফা দেবে।

কিন্তু শায়লা পারেনি নিজের পরিবারকে আটকাতে। সে এখন শায়ান নামের একটা ছেলের মা। গত বছরই শায়লার বিয়ে হয়ে যায়। তোমাদের এটা কখনো বুঝতে দিইনি। কারণ, যদি বুঝতে দিতাম, তোমরা হয়তো আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে। আর বিয়ে করলে আমি তখন একটা বন্ধনে আটকে যেতাম। তখন আমি তোমার ঋণ এত তাড়াতাড়ি শোধ করতে পারতাম না। ঋণের বোঝা মাথায় থাকলে, একটা অন্য রকম অস্বস্তি কাজ করে। আমি সে অস্বস্তি থেকে বের হতে চেয়েছিলাম খুব দ্রুত।

বাবার চোখ দিয়ে যখন পানি বেয়ে পড়ছে, তখন বললাম, বাবা, কপালে যাকে আল্লাহ রেখেছেন, সে আসবে সময় হলেই। কিন্তু মা–বাবা দুঃখ পেলে, সে দুঃখ সন্তানদেরও ছুঁয়ে যায়। তাই আমি আগে তোমাদের কথাই ভেবেছি।

আমার কথা শুনে বাবার কান্না আরও বেড়ে গেল।