বাবাকে কখনো জড়িয়ে ধরা হবে না
বাবার মুখের হাসি ছিলাম আমি, আবার তাঁর চোখের কান্নাও ছিলাম। ওনাকে নিয়ে যত লিখব, ততই কম মনে হবে। বাবার সবকিছুতেই ছিলাম আমি।
জন্মের পর থেকে কখনো আমার গায়ে হাত তোলেননি বাবা। যতই ভুল কাজ করতাম, সব দোষ পড়ত আম্মুর ওপর। এটা মনে হয় সব বাঙালি বাবার বৈশিষ্ট্য। জন্মদিনে সবার আগে তিনি আমাকে শুভেচ্ছা জানাতেন। এই দিনের কথা কারও মনে না থাকলেও বাবার ঠিকই মনে থাকত। জীবনে ওনার কাছে কিছু চেয়ে পাইনি, এমনটা কখনো ঘটেনি।
আব্বুর দেওয়া টাকা জমিয়ে বিভিন্ন শখের জিনিস কিনতাম। আমার ভুলে যাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। কোথাও গেলে বিভিন্ন জিনিস ভুলে রেখে চলে আসতাম অথবা হারিয়ে ফেলতাম। ঘরে এসে মন খারাপ করলে বাবা বলতেন, পরের মাসে টাকা পাঠাব, তখন আবার কিনে নিস। বাবা প্রবাসে থাকতেন। স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর সন্তান একদিন বড় মানুষ হবে, একটা ভালো চাকরি করবে, মাকে ভালো রাখবে।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে হঠাৎ করেই বাবার শরীরে ক্যানসার শনাক্ত হয়। প্রবাসেই ডাক্তার দেখান তিনি। রোগ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ। সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া হয়। বাবা ধীরে ধীরে ভালো অনুভব করতে থাকেন। আমরাও বিশ্বাস করতে শুরু করি, উনি হয়তো দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন।
থেরাপি ও মেডিসিন একসঙ্গে চলছিল। ২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, অতিরিক্ত বমি করার ফলে হঠাৎ করেই বাবার ইলেকট্রোলাইট কমে যায়। রাত একটায়, ঢাকার আহছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। পরের দিন সাধারণ বেডে নিয়ে আসা হয়, কিন্তু বড় সমস্যা হয়ে যায় ওনার পেটের ভেতর। বাবার পেট ফুলতে থাকে, ডাক্তাররা প্রথমে ভেবেছিলেন হয়তো ক্যানসারের কারণে পানি আসছে। টানা চার দিন ঘুমাতে পারেননি, পঞ্চম দিন এসে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। কাউকেই চিনতে পারেননি। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। হাসপাতাল থেকে বাবাকে রিলিজ দিয়ে দেওয়া হয়।
পরে লক্ষ্মীপুর আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করাই। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর বাবাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাই। এভারে চার মাস চলতে থাকে। পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা চলে। এই সময়ে তিনি স্বাভাবিকভাবে খেতে পারতেন না। ১ জুন, রাতে বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। খবর শুনে পরদিন ভোরে বাড়ি চলে যাই। তিন দিন ছিলাম, ওনার সেবাযত্ন করেছি। ৫ তারিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা ছিল, এ কারণে আগের দিন আবারও ঢাকায় ফিরে আসি। পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি। হলে সারাক্ষণ অস্বস্তিতে ছিলাম। দ্রুত বাসায় চলে আসি। এসেই বাবার মৃত্যুর সংবাদ পাই।
মুহূর্তের মধ্যেই অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ি। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। জীবনে যেন অন্ধকার নেমে এল। ছয় ঘণ্টার বাস জার্নি শেষে গ্রামে পৌঁছাই। এই ছয় ঘণ্টা মনে হয়েছে অনন্তকাল!
বাবাকে অনেকবার বুকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছি। কিন্তু কখনো সাহস হয়নি। আর কখনো সেই আশা পূরণ হবে না।
লেখক: শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি