বাইসাইকেল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ক্লাস সিক্সে ওঠার আগেই আব্বুর কাছে বায়না ছিল একটা হিরো রেঞ্জার সাইকেলের। আব্বু ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। বাসাভাড়া, বিভিন্ন বিল আর সংসারের খরচ চালিয়ে একটা বাইসাইকেল কিনে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু একটা ১২ বছরের ছেলের কাছে তার আব্বুর অসচ্ছলতার চেয়ে শখের মূল্য অনেক বেশি। তাই বায়নাটা জিদে রূপান্তর হতে খুব বেশি সময় লাগল না।

আমার এই জিদের জন্য আব্বু কখনো আমাকে কোনো বকা দেননি। তিনি বলতেন, আর কয়েক দিন পরেই কিনে দেব। আমিও ঠিক প্রতিদিন বিকেলে অপেক্ষায় থাকতাম আজ বুঝি আমার সাইকেল বাড়িতে আসবে। সাইকেল আসার পর ঠিক কোথায় কোথায় ঘুরতে যাব, তা–ও ঠিক করে রাখতাম। সাইকেল আর আসত না। প্রতিদিন আমার শখের স্বপ্ন ভেঙে যেত আব্বুর ওই সাইকেল না নিয়ে বাড়ি ফেরার দৃশ্যে।
সিক্সে ওঠার পর জিদটা খুব বেশি হয়ে গেল। আব্বুর ওপর খুব অভিমান হতো। মনে হতো আব্বু এমন কেন? একটা সাইকেল কিনে দিলে কী হয়? আম্মু কোনো কথা বলতেন না। বাবা–ছেলের মধ্যে এ বিষয়ে তিনি দূরে বসে হয়তো তখন দুই মনের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা এবং চাহিদার মিশ্রণের চেষ্টা করে যেতেন।

আমার সাইকেলের বায়না যখন খুব বেশি পর্যায়ের হয়ে গেল, আম্মু তাঁর ভাই মানে আমার মেজ মামাকে ফোন করে জানালেন এই জিদের কথা। বাবার সামর্থ্য না থাকলেও মামাদের সামর্থ্য ছিল এই বায়না পূরণের। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মেজ মামা আমাকে একটা নীল সাইকেল কিনে দিলেন।
সেদিন ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন। আমি সাইকেল পেয়ে আব্বুর প্রতি রাগ অভিমান সব ভুলে গিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বন্ধুদের নতুন সাইকেল দেখাতে। সেদিনের সব স্মৃতি আমার মনে নেই, এটুকু মনে আছে, আব্বু খুব খুশি হয়েছিলেন। হয়তো নিজে কিনে দিতে পারেননি বলে মনে কষ্ট ছিল। সেটি আড়াল করে আমার খুশিতে হাসতে তিনি কার্পণ্য করেননি।
সারা দিন ঘোরাঘুরির পরে ঠিক সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে এসে সাইকেলটা রেখে হাত–মুখ ধুয়ে পড়তে বসেছি। খুব বেশি হলে ১০ মিনিট পড়ার পর আম্মু এসে আমাকে বললেন, সাইকেলটা ঘরের মধ্যে তুলে রাখতে। আমি তাঁর কথা শুনে বারান্দায় এলাম। কিন্তু সেখানে এটা ছিল না। সেদিন এলাকার এমন কোনো জায়গা বাদ দিইনি, সবখানে খুঁজেছি।

নিজের স্বপ্ন চোখের সামনে এইভাবে হারিয়ে গিয়েছে যে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না। পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। সাইকেলটা এভাবে চুরি হয়ে যাবে কেনার দিনই, সেটা হয়তো ভুল করেও কখনো কল্পনাতে আসেনি। সারা রাত আমি ঘুমাইনি, শুধু কেঁদেছি। আব্বু-আম্মু সারা রাত আমার পাশে বসে ছিলেন। আম্মুও হয়তো কেঁদেছে, তবে আব্বু তাঁর কান্না আমাদের দেখাননি। হলফ করে বলতে পারি, আমার সেদিনের কান্নার চেয়ে অনেক বেশি অশ্রু আব্বুর মন দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ছেলেদের মানুষকে কান্না দেখাতে নেই; এ কারণেই হয়তো বাবার কান্না কেউ দেখেনি। আমি বুঝেছিলাম। সেই চাহনি বাবা মারা যাওয়ার ১০ বছর পরেও ভুলতে পারিনি।

পরের দিন সকালেই আব্বু অফিসে চলে গেলেন। আমি স্কুলে যাইনি, ইচ্ছা করেনি। আব্বু বাসায় আসতেন বিকেল পাঁচটার পরপরই। সেদিন সন্ধ্যার পরেও ফেরার নাম নেই। আম্মুর কাছে কারণ জানতে চাইলেও তিনি বারবার এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। মনে মনে ভাবছিলাম কী এমন হলো যে আম্মু এমন করছে, আর আব্বুই বা কেন আসছে না!
রাত আটটার দিকে বাড়ির দরজার নয়। আমি নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজার ওপাশে আব্বু ছিলেন, তাঁর সঙ্গে ছিল একটি সাইকেল। নতুন সাইকেল। শুধু পার্থক্য রঙের। নীল ভালোবাসা হারিয়ে গেলেও সেটি লাল হয়ে ফিরে আসে আমার কাছে।

সেদিনের মতো খুশি আর কখনো হয়েছি বলে মনে হয় না। আব্বুর চোখে আমার জন্য যে ভালোবাসা দেখেছি, তা কোনো শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যাবে না। সারা দিনরাত কষ্টে থাকার পর আমার আনন্দ ছিল বাঁধভাঙা। আব্বুর ধার করা টাকায় কেনা সেই বাইসাইকেল আমার খুশি ফিরিয়ে দিয়েছিল। আজ সেই খুশি আমাকে নীরবে কাঁদায়। সান্ত্বনা এইটুকু যে আজ বাবা বেঁচে না থাকলেও আছে তাঁর দেওয়া সেই ভালোবাসার লাল সাইকেল।

লেখা: সাধারণ সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা, পাবনা