বাংলাদেশের ‘আগরতলা’ খ্যাত মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠার গল্প

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। ভারতে যেতে যে প্রধান রুটগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল আড়িয়াল খাঁ ও ব্রহ্মপুত্র নদ বিধৌত নরসিংদী জেলার বেলাব-মনোহরদী অঞ্চল ব্যবহার করে ভারতের আগরতলায় পৌঁছানো।

বেলাব-মনোহরদী অঞ্চল নদী-খাল-জলা এবং ঝোপ-জঙ্গল-গাছপালা ঘেরা হওয়ায় ভৌগোলিকভাবে বেশ দুর্গম ছিল। ঢাকা ও এর আশপাশের অঞ্চলের মানুষ যখন চরম অনিরাপত্তা ও জীবন শঙ্কায় ছিল, তখন নিরাপদে ভারতের আগরতলায় যাওয়ার রাস্তা হিসেবে এই এলাকা ব্যবহার করত। ২ ও ৩ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ত্রিপুরার আগরতলায়। এর নিকটবর্তী অঞ্চল হিসেবে ওই এলাকা শত্রুমুক্ত রাখা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অন্যতম নির্দেশনা ও দায়িত্ব। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই সেক্টর দুটির আওতাভুক্ত এলাকার লোকজন অস্ত্র, গোলাবারুদ ও যুদ্ধের রসদ আনা-নেওয়ার জন্য এই এলাকাকে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করত।

একাত্তরে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বেলাব-মনোহরদী অঞ্চল দিয়ে ভারতের আগরতলায় চলাচলের পথকে শত্রুমুক্ত রাখাতে ভূমিকা রাখে এফএফ গেরিলা বাহিনী ও নিয়মিত বাহিনীর একটি দল। এফএফ গেরিলা ও নিয়মিত—এই দুই বাহিনীর সমন্বয়ে ওই এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা হয়। নিয়মিত বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন ইপিআরের কাজী আকমল ও কাজী ওসমান ভ্রাতৃদ্বয়। আর এফএফ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আহমেদ।

ইনকা সাম্রাজ্যের বার্তা প্রেরণ পদ্ধতির মতো তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ওই এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছিলেন। বেলাব থানার বিন্নাবাইদ ইউনিয়নে জন্ম আবেদ আহমেদের রাজনীতির সূত্রে ওই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থা সম্পর্কে আগে থেকেই নখদর্পণে ছিল। ফলে গেরিলা যুদ্ধে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা একের পর এক সাফল্য অর্জন করেন।

যুদ্ধদিনের মনোহরদী-বেলাব কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সে সময় বলা হতো এটি ‘বাংলাদেশের আগরতলা’। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশিরা যেমন নিরাপদ অনুভব করতেন, যুদ্ধে তাড়া খাওয়া বিপন্ন ব্যক্তিরা ঠিক তেমনটিই বোধ করতেন বেলাব-মনোহরদী এলাকায় পৌঁছে। ঢাকা-গাজীপুর-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি জেলার লোকজন কখনো নৌকায়, কখনো হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর, নবীনগর, কসবার মনতলা-মনিহন্দ ও ভারতের চারিপাড়া এবং সরাইলের আজবপুর, নাসিরনগর, হরিণবেড়, মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া-কাতলামারা ইত্যাদি সীমান্তপথে পাড়ি দিত। এই রুটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, আগরতলায় অবস্থিত বিভিন্ন ক্যাম্পে যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে যাওয়া তরুণ-যুবা ও শরণার্থীদের নিরাপদে পৌঁছার রাস্তা নির্বিঘ্ন রাখা, অস্ত্র-গোলাবারুদ ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদান।

এফএফ গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার আবেদ আহমেদ এবং নিয়মিত বাহিনীর কাজী আকমল ও কাজী ওসমান ভ্রাতৃদ্বয়ের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় এই এলাকায় বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রামপুর, মাধুপুর কাচারী, মনোহরদী সদর পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি, দশদোনা, বিলাগী এবং পোড়াদিয়া থেকে চরসিন্দুর পর্যন্ত পলায়নপর শত্রুসেনাদের মোকাবিলা ও পিছু ধাওয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই অঞ্চলের নিরাপত্তা বিবেচনায় মানুষের মুখে মুখে ওই এলাকা বাংলাদেশের ‘আগরতলা’ নামে খ্যাত ছিল।

যুদ্ধের সময় তরুণ আবেদ আহমেদকে প্রথমে ভারতের আগরতলার জয়নগর স্কুল ইয়ুথ ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণের জন্য অম্পিনগর ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হয়। সেখানে নিয়মিত যুদ্ধের জেনারেল ট্রেনিং নেন। ওখানে অবস্থানকালে পাঁচটি কোম্পানি থেকে বাছাই করা শিক্ষিত ও মেধাবী তরুণদের নিয়ে আলাদা করে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিতেন মেজর আব্রাহাম। অম্পিনগরে প্রশিক্ষণ শেষে তিনি চূড়ান্ত গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষ করেন মেলাঘরে মেজর এ টি এম হায়দারের নেতৃত্বে।

প্রশিক্ষণে যাতে প্রশিক্ষক বাড়তি সুবিধা না দেন, সে জন্য নিজের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রেখে প্রশিক্ষণ শেষ করেন। অসামান্য দক্ষতা ও গেরিলাযুদ্ধের কলাকৌশল নিপুণভাবে আয়ত্ত করায় ২ নম্বর সেক্টরের প্রধান কমান্ডো মেজর এ টি এম হায়দারের নজরে আসেন তিনি। দায়িত্ব পান এফএফ গেরিলা অধিনায়ক হিসেবে বেলাব-মনোহরদী ও সংলগ্ন গেরিলা অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত রাখার।

রাজনীতিতে আসা যেভাবে

আবেদ আহমেদ ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। মানিকগঞ্জ সরকারি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় ডিস্টিংশনসহ প্রথম বিভাগে পাস করেন তিনি। ১৯৬২ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তখন দেশব্যাপী চলা বাষট্টির হামুদুর রহমান কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন চলছিল। সে সময় তিনি বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাঁর হাত ধরে ছাত্ররাজনীতির হাতেখড়ি নেন।

তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খাঁর বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জে। তিনি মোনায়েম–বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও তিনি একসঙ্গে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে ওই কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। পরে ৬৬-৬৭ সালের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়ে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন আবেদ আহমেদ।

বিএসসি পড়াকালে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে পুলিশ আবেদ আহমেদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে।

১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানে আইয়ুব-সমর্থক বিডি মেম্বারদের জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন আবেদ আহমেদ। এ আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি মামলার আসামি হন। আর ওই মামলার জামিন বিষয়ে কথা বলতে গিয়েই তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রথম সাক্ষাৎ ও স্নেহস্পর্শ লাভ করেন।

১৯৭০ সালে তরুণ এই ছাত্রনেতা মনোহরদী থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

যুদ্ধে যোগদান

আবেদ আহমেদ ১৯৬৯-৭০ সালে চলে আসেন তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার বেলাব-মনোহরদী অঞ্চলে নিজ এলাকায়। সত্তরের জাতীয় নির্বাচনে তিনি মনোহরদী থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওই অঞ্চলে মূল সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন তিনি। যুদ্ধের সময় নিজের রাজনৈতিক পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলেন আবেদ আহমেদ। চাইলেই তিনি এমপিএ-এমএনএদের সঙ্গে থেকে দাপ্তরিক কোনো কাজে যুক্ত হতে পারতেন। কিন্তু তাঁর মনে ছিল সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করার অটল প্রত্যয়। এমপিএ ফকির সাহাব্বুদ্দিন (প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল), অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান ভূইয়া এমএনএ প্রমুখ কংগ্রেস ভবনে থাকার জন্য চাপাচাপি করা সত্ত্বেও তিনি পাশের জয়নগর স্কুল ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দেন।

চূড়ান্ত গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সেক্টর কমান্ডার মেজর এ টি এম হায়দারের কাছ থেকে। নিজের যোগ্যতায় নজর কেড়েছেন সেক্টরপ্রধানের।

ভারতে প্রশিক্ষণকাল সম্পকে৴ এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ছাত্র রাজনীতি করার সময় আমার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংগঠিত স্বাধীনতা-বিপ্লবের ইতিহাস পড়া ছিল। মাত্র ৯ মাসে দেশ স্বাধীন হবে, সেটা ছিল অচিন্তনীয়। তাই দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কৌশল হিসেবে গেরিলা প্রশিক্ষণ আমাকে আকৃষ্ট করেছিল।

প্রশিক্ষণ শেষে বেলাব-মনোহরদী অঞ্চলের এফএফ গেরিলাবাহিনীর দায়িত্ব পান তিনি। মনোহরদী ও পাশের অঞ্চলে অবস্থানরত সব মিলিটারি ফোর্স (এমএফ) ও ফ্রিডম ফাইটারকে (এফএফ) তাঁর অধীনে ন্যস্ত করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীরা প্রশাসনিক কাজের দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এফএফ গেরিলা ও নিয়মিত বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

মোট আটটি গ্রুপে পাঁচ শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁর নেতৃত্বে। তাঁর দুটি গ্রুপের সম্মুখযুদ্ধ ‘বিলাগী’ ও ‘দশদোনা’র খবর সে সময় আকাশবাণী রেডিওতে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়েছিল। বিলাগী যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাম্বুশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩টি সেনাভর্তি গাড়ির ২টি উল্টে যায় এবং ১৯ জন নিহত হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবেদ আহমেদ
ছবি: সংগৃহীত

উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ–বর্ণনা

মনোহরদী থানায় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প মুক্ত করা ছিল আবেদ আহমেদের উল্লেখযোগ্য একটি সম্মুখযুদ্ধ। একাত্তরের অক্টোবরের ২১ তারিখে তিনি, কাজী আকমল ও কাজী ওসমানের যৌথ পরিকল্পনা ও পরিচালনায় এই ক্যাম্পে চূড়ান্ত আক্রমণ করা হয়। এই যুদ্ধের অন্যতম সফলতা ছিল চারজন পাকিস্তানি সেনাসহ কমান্ডার সুবেদার জুলফিকারকে জীবিত আটক করা এবং সহযোদ্ধাদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হওয়া।

এ ছাড়া ১১ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ভৈরব থানা ঘাঁটির পতন হলে বেলাব-মনোহরদী অঞ্চল দিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টগামী পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধে তিনি সরাসরি মুখোমুখি যুদ্ধে একজন আহত সেনাকে আটক করতে সমর্থ হন। পাশাপাশি তাদের চরসিন্দুর পর্যন্ত ধাওয়া করে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি গ্রুপের মাধ্যমে ১৭ জনকে আটকে ভূমিকা রাখেন।

১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর মেজর ভর্মা হেলিকপ্টারে নরসিংদী সদরে অবতরণ করলে তিনি জ্বালানিসহ গাড়ির ব্যবস্থা করে মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনে সহায়তা করেন।

আবেদ আহমেদের বড় ছেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহ মো. আরিফুল আবেদ। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসেও মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা ও সংরক্ষণের তাগিদ বিদ্যায়তনিক বা সাধারণ পরিসরে তেমন হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সঠিক জাতীয় ইতিহাস যেমন দরকার, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তিক পর্যায়ের ঘটনা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবদানও লিপিবদ্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরি। আরিফুল আবেদ আরও বলেন, বাংলাদেশের ‘আগরতলা’ বেলাব-মনোহরদী অঞ্চলকে যেকোনো মূল্যে শত্রুমুক্ত রাখার বিশেষ নির্দেশনা ছিল সেক্টর থেকে। ওই মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠায় যাঁরা অবদান রাখেন, তাঁদের কৃতিত্বের স্বীকৃতি রাষ্ট্রীয়ভাবে দেওয়া প্রয়োজন।

যুদ্ধের পরেও এলাকা রেখেছেন নিরাপদ

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনতা লাভ করে, সবাই বাড়ি ফিরলেও আবেদ আহমেদের বাড়ি ফেরা হয় না। কারণ, স্বাধীন হওয়ার পরও প্রায় দেড় মাস পর্যন্ত তাঁকে এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকতে হয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশে এই এলাকার প্রথম সিও (ডেভ) সিও (রেভ), ওসিসহ অন্যান্য অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাঁর হাতে যোগদানপত্র দিয়ে কার্যভার গ্রহণ করেন। পরে তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে অস্ত্র জমা দেন এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের ৩ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর থেকে সরবরাহ করা ওসমানী স্বাক্ষরিত সনদপত্র বিতরণ করেন। সিও (ডেভ) সিও (রেভ), ওসিসহ অন্যান্য অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যোগদানের আগ পর্যন্ত তিনি অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ওই অঞ্চলের শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বজায় রাখেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন সহজ ছিল না। চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি ও জনগণের জানমাল রক্ষার পাশাপাশি সরকারি সম্পদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেন তিনি। প্রশাসন ও পুলিশ দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত কোটি কোটি টাকা মূল্যের সার, পাটের গুদাম ও শতাধিক শ্যালো ইঞ্জিনের ওয়্যারহাউস সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লুট করা লক্ষাধিক টাকা লুটেরাদের কাছ থেকে উদ্ধার করে তা বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত দিয়ে তিনি সততার অনন্য নজির গড়েন।

এই বীর মুক্তিযুদ্ধার বক্তব্য, ‘যুদ্ধের সময় প্রায় প্রতিমাসেই আমাকে ওপারে সেক্টর দপ্তরে অস্ত্র-গোলাবারুদ ও প্রশিক্ষণ শেষে নতুন রিক্রুট হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপে গ্রুপে ভাগ করে আনতে হতো। এ সময় আমার এলাকার সর্বশেষ যুদ্ধপরিস্থিতি রিপোর্ট আকারে পেশ করে নতুন কোনো নির্দেশনা থাকলে নিয়ে আসতাম। আমার অধীনস্থ এলাকায় আশ্রয় নেওয়া এবং সীমান্তে পার হওয়া লোকজন সেক্টর দপ্তর ও আগরতলায় গিয়ে এই এলাকাকে বাংলাদেশের “আগরতলা” বলে নামকরণ করেন। মায়ের কোলে একজন শিশু যেমন নিরাপদ থাকে, আমারও মনে মনে প্রতিজ্ঞা ছিল বেলাব-মনোহরদী অঞ্চলকে তেমন রাখা।’

আবেদ আহমেদের অভিমান মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান সংজ্ঞা ও তালিকাভুক্তি নিয়ে। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মাত্র ১৯ শব্দে ‘মুক্তিযোদ্ধা’কাদের বলা হবে, সেটির সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। অথচ তাঁর সংজ্ঞাকে উপেক্ষা করে এখন বিভিন্ন ফর্মুলায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নিষ্পত্তি করা বিষয়ের এমন অবমাননা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে ৯৪ নম্বর অধ্যাদেশে, ৭ আগস্ট প্রকাশিত গেজেটে ‘মুক্তিযোদ্ধা’র সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলেন এভাবে, ‘Freedom Fighter means any person who had served as a member any force engaged in the war of liberation but shall not include members of the Defence Services or the police or the Civil Armed Forces.

তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা বাস্তবায়নে জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়