বসন্তের চিঠি
প্রিয় বসন্ত,
ঘড়ির কাঁটার মতো চলতে চলতে সময়ের গণ্ডিতে যখন থেমে গেলাম, তখন তুমি ডাকলে তোমার কুহু কুহু রবে। কী করে বরণ করি তোমায়! শূন্যের বৃত্তে আমি এখন আবর্তিত হই। ভেসে বেড়াই কালো মেঘের সারথি হয়ে। তুমি হয়তো জানো না, পঞ্চাশ বছর ধরে আমি অপেক্ষায় থেকেছি তোমার জন্য। অথচ এত বছর পর যখন তুমি এলে, তখন আমার ক্ষীণদৃষ্টি। এলে আমার কপালের ভাঁজে। আমার খসখসে ঝুলন্ত ত্বকের ভাঁজে। এলে আমার ভগ্নহৃদয়ে। কোথায় রাখব তোমায় বলো! তুমি হয়তো জানো না, আমি ক্ষণে ক্ষণে ডুবে যাই ঢেউহীন নদীর কান্নার নোনাজলে। যেখানে মাছেরাও আসে না প্রজননে বেলায়-অবেলায়।
প্রিয় বসন্ত, জীবনের ক্যানভাসে সাত রঙে সাজিয়েছিলাম একসময় তোমাকে। সায়রের কল্লোলে ভাসতাম তোমায় নিয়ে। শরতের তুলোট মেঘে নাও ভাসাতাম। গোধূলি আবিরে রাঙিয়ে যেত মন। কাশফুলের পরশে পরশে আঁকতাম তোমায়। দুচোখে মাখতাম প্রেমের অঞ্জন। প্রেমের আগুনে তুষের মতো পুড়তাম নিজে। সে কী ভালো লাগা! কী শিহরণ! আজ যখন এত বছর পর এলে আমার দ্বারে, তখন তোমায় আর কী শোনাই বলো। তবুও তুমি নাছোড়। শুনতে চাও আমার কথা? হ্যাঁ, আজ আমি তোমাকে শোনাব। পারবে তো তুমি সইতে?
প্রিয় বসন্ত, ঘাসের মতো পায়ের আঘাত আমাকে সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়ত। বুকের ওপর পথ করে হেঁটে চলে পথিকেরা। আমার ইচ্ছেগুলো ঝুলে থাকে ইলেকট্রিক তারে। একটু একটু করে শক দিয়ে সংকুচিত করে আমার রক্তপ্রবাহ। হাত পোড়ে, পা পোড়ে। সেই পোড়ানো তাপে আমার হৃদয় রাখি। হৃদয় পোড়া পারফিউম মাখি প্রতিদিন। তুমি কি শুনেছ কচি সবুজ পাতার আড়ালে ঝরা পাতার কান্না? দেখেছ কি গ্লানির শেকড়ের গভীরতা? প্রৌঢ়ত্বের বিগলিত আঁখিতে শ্রাবণের বারিধারা?
শিশিরে ঝরে যাওয়া শিউলির কান্না? তুমি কি শুনতে পাও ঝরা পাতার মড়মড় শব্দে ভাঙনের সুর?
প্রিয় বসন্ত, ভৌতিক সুরে হুতোম পেঁচা কাঁদে গ্রেনেড হামলায়। বৈষয়িক চাহিদার নগ্ন হাত আমার মনুষ্যত্বকে হরণ করেছে। শহরের নিয়ন আলোয় তরুণেরা পান করছে মদের সাম্পান। চোখে-মুখে তেজ নেই। রক্তে বারুদ ফোটে না। যোনি ছেঁড়া রক্তে পরিতৃপ্ত দুই পাওয়ালা পশুর দল। ধর্মের লেবাসে ঢেকে যায় বিজ্ঞানের আলো। আমার ঈশ্বর বকধার্মিকদের পদতলে পিষ্ট হয় প্রতিনিয়ত। ঈশ্বরও পালিয়ে বেড়ায় ইউক্রেনের গর্ভবতী নারী ও নিষ্পাপ শিশুদের মতো। কাচের মতো ভাঙছে পরিবার ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সমাজ, রাষ্ট্র। ভাঙছে বিশ্ব নিখিল। সেখানে তুমি আর আমি কী করতে পারি বলো!
প্রিয় বসন্ত, কিছু কিছু দুঃখ আছে, যা সাগরের মতো প্রাণবন্ত, দেয়ালে পেরেকবিদ্ধের মতো লেগে থাকে জীবনের মসৃণ দেয়ালে। যেটা দেখলে আঁতকে উঠি মুহুর্মুহু। বিশ্বনিখিল পান করছে নিকোটিনের বিষ। জলোচ্ছ্বাসের মতো ফুঁসে উঠছে মৃত্যুর নগর। রাশিয়া, ইউক্রেনের নির্লজ্জ আগ্রাসনে বইছে মৃত্যুর ঢেউ। সভ্যতার আড়ালে ভেতর-বাহির পুড়ছে চিতার আগুনে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে লাখ লাখ যুদ্ধাহত সৈনিক। দেখো, সাগরের জলরাশি খণ্ড খণ্ড তামায় পরিণত হয়েছে পারমাণবিক বিস্ফোরণে।
প্রিয় বসন্ত, তোমার সমীরেও এখন লাশপোড়া গন্ধ। সারা বিশ্বের আকাশ বারুদের কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে থাকে। লাখ লাখ মানুষের আর্তনাদ আর আহাজারি বেদনার সুর হয়ে বাজে বাঁশের বাঁশিতে। নীড়হারা বিহঙ্গী ঘুরতে ঘুরতে আছড়ে পড়ে পোড়া মৃত্তিকায়।
তবু আমি বেঁচে আছি। তোমার অপেক্ষায়। তুমি কি জানো? সংসারগুলোয় এখন প্রতিনিয়ত চলছে ভাঙনের হোলিখেলা। ভাঙছে পরিবার। হৃদয়ের টান আর নেই। প্রেমে নেই চুম্বক শক্তি। আছে বিস্ফোরণ। নেগেটিভ–পজিটিভের মহাবিস্ফোরণ। প্রেমে এখন হেমলকের বিষ। এখন কারও অপেক্ষায় ভেজে না শাড়ির আঁচল। ত্রিশ বছরের হাড়ভাঙা খাটুনির কঙ্কালসার স্ত্রীকে ছুড়ে ফেলা হয় ব্যাকডেটেট বাক্সে। প্রেমিক এখন খুঁজে বেড়ায় অভিনব প্রেমিকার মিলনের ঘর্মাক্ত শরীরের গন্ধ। ক্ষুধার্ত নিশিগন্ধা ছুটে বেড়ায় রাতের আঁধারে। ধর্ষিত শিশু ও নারীর যোনির রক্তে ভেজে আমার লাল-সবুজের পতাকা। তাই তো বসুমতী এখন প্রতিদিন জন্ম দেয় হাজারো অবাঞ্ছিত সন্তান।
প্রিয় বসন্ত, ভেবেছিলাম বিবেক, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধের জায়গা মানুষ গঠনের কারখানার এক কোণে হয়তো তোমাকে একটু ঠাঁই করে দিতে পারব। তাই চৈত্রের খরায় উত্তপ্ত পথ মাড়িয়ে ঘুরেছিলাম দ্বারে দ্বারে। পায়ের তলার বড় বড় ফোসকার যন্ত্রণা সয়েছিলাম নীরবে। কিন্তু দেখলাম, কারিগরদের মেরুদণ্ড ভেঙে মুখ খুবড়ে পড়ে আছে সরীসৃপদের মতো। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। ক্যালসিয়ামের অভাবে দুই–একজন ক্ষয়ে যাওয়া মেরুদণ্ড নিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে চলেছে। তুমি শুনে বিস্মিত হবে, ভবনগুলোও সেদিন আমাকে দেখে বিদ্রুপের হাসি হেসেছিল।
তুমি জানো, মাঝেমধ্যে আমার কী মনে হয়?
মনে হয়, এই কলুষিত ধরিত্রীকে ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দিয়ে নতুন করে গড়ি। আমার আত্মার অন্তর্ভেদী আর্তনাদে প্রকম্পিত হয় আকাশ-বাতাস। আবার থমকে যায়। নাম না জানা প্রাণীগুলো পদতলে পিষ্ট হওয়ার ভয়ে। জানি না, কী করব! তাড়া খাওয়া হরিণের মতো পালিয়ে বেড়াই যুদ্ধের জলন্ত উনুনের মুখে। আমি জানি, তুমি পড়তে পড়তে অধৈর্য হয়ে পড়বে। তাই তোমার ধৈর্যের বিচ্যুতি ঘটাতে চাই না আর। তবু বলি বসন্ত, আজও ভালোবাসি তোমায়। ভালোবাসব তোমায় আজীবন। জীবনপ্রদীপটা যদি হঠাৎ করে নিবে না যায়। তোমায় নিয়ে আবার সাজাব প্রেমের বাঁশরি। আমি স্বপ্ন দেখি একটু আশায়, একটু ভালোবাসায়। আবার ভরাতে চাই ভালোবাসার ফুলের বাগান, যেখানে তোমার–আমার ভালোবাসার কাননে পাখিরা কিচিরমিচির করবে। সবুজে সবুজে সাজবে নতুন একটি সুন্দর ধরিত্রী। ফসলের হাসিতে হাসবে বিস্তৃত সবুজ মাঠ। কৃষক হাসবে নতুন সূর্যোদয়ে। তুমি অপেক্ষা করো।
প্রিয় বসন্ত, শুধু একটু অনুরোধ করব তোমায়। আমি যখন থাকব না, তুমি আমার অনাগত প্রিয় সন্তানের আগামীর জন্য একখণ্ড উর্বর ভূমি রেখো। রেখো নির্মল বাতাস। মরুভূমির তলে লুকিয়ে রেখো বিশুদ্ধ অমিয়বারি। রেখো হেমন্তের একমুঠো সোনারোদ, যেখানে ভালোবাসার সাম্পানে ফুটবে প্রেমের অঙ্কুর। যেখানে থাকবে না কোনো যুদ্ধ, স্বার্থের আর আধিপত্যের কোনো দ্বন্দ্ব, সংঘাত। যেখানে থাকবে না মৃত্যুর হোলিখেলা। যেখানে রচিত হবে তোমার আমার মিলনে সাম্য, মৈত্রী, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার এক স্বর্গীয় উদ্যান।