বন্ধুদের অপারেশন

বন্ধুদের অপারেশনঅলংকরণ: তুলি

শীতের সকাল। চারদিকে ঘন কুয়াশা আর ঠান্ডা বাতাস বইছে। ইফাজ, ইনান, ওহি, রুহি ও পুলক সাতসকালে একসঙ্গে বেরিয়েছে ইংরেজি শিক্ষক রফিক স্যারের কাছে পড়তে। তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের পরিচয়। এর মধ্যে ইফাজ, ইনান, ওহি ও রুহি দশম শ্রেণিতে পড়ে। ইফাজ দশম শ্রেণির ক্লাস ক্যাপ্টেন। তাকে প্রায় সবাই মান্য করে। অন্যদিকে পুলক নবম শ্রেণিতে পড়ে ইংরেজি বোঝার সুবিধার্থে ওদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। খোশগল্প করতে করতে তারা রফিক স্যারের বাড়িতে পৌঁছাল। জানতে পারল স্যার জরুরি কাজে ঢাকা গিয়েছেন, আজ পড়াবেন না। সবাই তো মহাখুশি।

ইনান বললো সামনে পার্ক আছে, চল সবাই পার্কের দিকে যাই। ইনানের কথায় সবাই পার্কের দিকে এগিয়ে চললো। যেতে যেতে পার্কের ঠিক কাছাকাছি তারা একটি ছোট ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখলো। ইনান ব্যাগটি কুড়িয়ে নিলো এবং বুঝতে পারলো বুঝতে পারলো ব্যাগটি একটু ভারী। তাই কৌতুহলী হয়ে সবাইকে সাথে নিয়ে ইনান ব্যাগের চেইন খুললো। সবাই রীতিমতো ঘাবড়ে গেলো। এতো টাকা! ইফাজ বললো চোখে ঝাপসা দেখছি মনে হয়, ছুঁয়ে দেখে যে সবই ঠিক আছে। সকলের উদ্দীপনা বেড়ে গেলো।

ব্যাগটি নিয়ে সবাই পার্কের নির্জন স্থানে বসল। ইফাজ বলল, টাকাগুলো আমরা সবাই গুনে দেখি। গুনতে গুনতে সবাই হিসাব করল মোট পঞ্চাশ হাজার টাকা। সবাই অবাক। এত টাকা তারা জীবনেও ছুঁয়ে দেখেনি। কী করা যায়? সবার মাথায় নানা রকম চিন্তা আসতে থাকল, রুহি বলে যেহেতু এই টাকার মালিক নেই, আমরা টাকাগুলো ভাগ করে নেব নাকি? ইফাজ বলল, বাদ দে এসব, আমরা সবাই মিলে দূরে রোমাঞ্চকর কোনো ট্যুরে যেতে পারি। পুলক বলল, আমরা কী কী করছি, সব আল্লাহ দেখছেন, কারও টাকা আত্মসাৎ করলে আমাদের পাপ হবে। আমাদের এই টাকার মালিককে খুঁজতে হবে, কিন্তু কীভাবে? ইনান দেখল ব্যাগটির একপাশে একটি পকেট রয়েছে। ইফাজ ভাবল, সেখানে আরও টাকা আছে। ব্যাগের পকেট খুলে সে একটি কার্ড পেল, যেখানে লেখা আছে নাম সারোয়ার আলম, পেশা এনজিও কর্মী, বয়স ৩২ বছর, রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ। এবার আসল মালিককে খুঁজতে তাদের বেগ পেতে হবে না। যদি মুঠোফোন নম্বরটাও থাকত তাহলে তো সহজেই তাকে পাওয়া যেত।

সবার মাথায় বিভিন্ন চিন্তা ঘুরতে লাগল। ইনান তার ফোনটা নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিল যে আমরা একটি টাকাভর্তি ব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছি। পার্কের পাশে। আসল মালিকের সন্ধান দিন। পুলকের মাথায় একটা বুদ্ধি এল। তার ব্যাগে কাগজ–কলম–আঠা সব আছে। সে তার ব্যাগ থেকে সাত-আট পাতা অফসেট পেপার নিয়ে বড় অক্ষরে লিখল মিস্টার সারোয়ার আলম সাহেব আমরা আপনার ব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছি। ব্যাগটি নিতে চাইলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। নিচে ইফাজের ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া হলো। ইফাজের ব্যাগ লম্বা হওয়ায় ইনান টাকার ব্যাগটি ইফাজের ব্যাগে সতর্কতার সঙ্গে রাখল, যাতে পার্কে কেউ কিছু না বুঝতে পারে। ইফাজ বলল, টাকাগুলো আমাদের বাড়িতে লোহার সিন্দুকে লুকিয়ে রাখব, কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি যোগাযোগ করলে আমরা সবাই মিলে তার ইটারভিউ নেব কোনো এক দোকানে কিংবা স্কুল মাঠে। এরপর পুলকের তৈরি পেপারগুলো তারা পার্কের পাশে রাস্তার মোড়ে দেয়ালের সঙ্গে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিল। তারপর সবাই বাড়ি ফিরে গেল।
সেদিন বিকেলে ইনান, ওহি, রুহি, পুলক স্কুল মাঠে গেল। তাদের সঙ্গে স্কুলের কতক বন্ধুর সঙ্গেও দেখা হলো। কিন্তু ইফাজ আসছে না। সবার মনে প্রশ্ন, ইফাজ কি টাকা নিয়ে ফেরারি হয়ে গেল নাকি? এটা ভাবতে না ভাবতেই ইফাজ এসে হাজির। ইনান কিরে কোনো খোঁজ পেলি?
ইফাজ, নাহ, কেউ যোগাযোগ করল না।

এরপর তারা বসে মাঠে জুনিয়রদের ফুটবল খেলা উপভোগ করতে লাগল। মিনিট দশেক পর হঠাৎ ইফাজের ফোনে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল। সবার কৌতূহল বেড়ে গেল। ফোন রিসিভ করতে একটি লোক বলল, আমি সারোয়ার আলম আমার একটি ব্যাগ হারিয়ে গেছে, আজ আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই। ইফাজ বলল, আপনি সোজা জিলা স্কুল মাঠে চলে আসেন, আমরা স্কুল মাঠেই আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটি এল। ওহি ও রুহি লোকটির ইন্টারভিউ নিল তার কোনো তথ্য মেলেনি। তারা লোকটিকে বলল, আপনার কোনো ব্যাগ হারায়নি, আপনি লোভে পড়ে এসেছেন। লোকটি লজ্জিত হয়ে চলে গেল। এদিকে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। সবাই যার যার মতো বাড়ি ফিরে গেল।
এরপর প্রায় দুই দিন হয়ে গেল। কেউ আর যোগাযোগ করেনি। পরদিন সকালে ইফাজের ফোনে আরেকটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল। ইফাজ খুশিমনে ফোনটি রিসিভ করল, ফোনে একজন লোক বলল আমি একজন এনজিও কর্মী আমার নাম সারওয়ার আলম। গত কয়েক দিন আগে আমি বাড়ি থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে পার্ক এলাকায় আমার টাকাভর্তি একটি ব্যাগ হারিয়ে যায়। আমি ব্যাংক থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। ব্যাগে আমার পরিচয় কার্ড আছে। শুনে ইফাজের আগ্রহ বেড়ে গেল। সে বলল, আপনার ব্যাগে কত টাকা ছিল? লোকটি বলল আমার ব্যাগে পঞ্চাশ হাজার টাকা ছিল। ইফাজ বলল, আপনি জিলা স্কুল মাঠের পাশের চা দোকানে বিকেল চারটায় আসবেন। এই বলে ইফাজ দৌড়ে ইনানের কাছে যায় এবং বাকিদের ফোন করে আজ দ্রুত স্কুলে আসতে বলে।

সবাই আটটা বাজে স্কুলে এসে হাজির। ইফাজ সবাইকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। এরপর স্কুল ছুটির পর তারা দোকানের দিকে এগোতে থাকল। দেখল একটি লোক বসে আছেন। ইফাজ লোকটিকে জিজ্ঞেস করলে আপনার নাম কী? লোকটি বললেন, আমার নাম সারোয়ার আলম, আমার ব্যাগ কি তোমরা পেয়েছ? ইনান বলল, হ্যাঁ পেয়েছি। তবে আঙ্কেল আপনাকে একটা পরীক্ষা দিতে হবে। লোকটি বললেন, কী পরীক্ষা দিতে হবে? এবার ইনান বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে পাশের হাসপাতালে চলেন আমরা আপনার রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করব। লোকটি তাদের সঙ্গে হাসপাতালে গেলেন। ইনান তার পকেটে থাকা এক শ টাকা দিয়ে লোকটির রক্ত পরীক্ষা করাল। এরপর রিপোর্টে দেখা গেল রক্তের গ্রুফ বি পজিটিভ। দেখে তো সবাই আহ্লাদিত। ইফাজ দৌড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে লুকিয়ে টাকার ব্যাগটা নিয়ে এল এবং লোকটিকে বলল, আঙ্কেল আপনি এই ব্যাগের আসল মালিক। আসলে আমরা এই ব্যাগের আসল মালিককে খুঁজছিলাম। গত দুই দিন আগে এক ব্যক্তি ব্যাগের মালিক দাবি করে নিজের নাম–পরিচয় সারোয়ার আলম দিয়েছিল। কিন্তু টাকার অঙ্ক ছাড়া কিছুই মেলেনি। এ জন্য আপনার পরীক্ষা নিয়েছিলাম, আপনি কিছু মনে করবেন না।
এই কথা শুনে সারোয়ার আলম অনেক খুশি হলেন এবং বললেন বাবারা তোমাদের কাছে আমি ঋণী। তোমরা আমাকে বাঁচিয়েছ। আমি আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম যে এ টাকা আর পাব না। আমি তোমাদের পুরস্কৃত করতে চাই এবং কিছু টাকা দিতে চাই তোমরা কী বলো? সবাই বলল, আমাদের কিছু খেলার সামগ্রী কিনে দিলে আমরা এতেই খুশি এবং আমরা আপনার কাছে দোয়া চাই যেন বড় কিছু হতে পারি। সারোয়ার আলম একটি স্পোর্টস দোকান থেকে তাদের পাঁচটি ফুটবল, পাঁচটি ব্যাট, বলসহ আরও কিছু জিনিস কিনে দিলেন। বললেন, আমার জন্য দোয়া করো তোমরা। এই বলে তিনি বিদায় নিলেন। খেলাধুলার সামগ্রী পেয়ে ইফাজ, ইনান, ওহি, রুহি ও পুলকের আনন্দের সীমা রইল না।