প্রযুক্তিই হবে টিকে থাকার ও এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়

• কাজী হাসান রবিন

প্রতীকী ছবি

কোভিড-১৯–এর প্রভাবে বিশ্বজুড়ে ব্যাহত হচ্ছে দৈনন্দিন স্বাভাবিক কার্যক্রম। স্থবিরতা এসেছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। আর ব্যবসা–বাণিজ্যের ওপর পড়েছে সুদূরপ্রসারী ঋণাত্মক প্রভাব। এই অবস্থা চলতে থাকলে ইতিমধ্যে সাময়িকভাবে বন্ধ থাকা অনেক প্রতিষ্ঠান অচিরেই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। এসব ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে। এমন বাস্তবতায় পৃথিবীর শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোও ভয়াবহ মন্দার আশঙ্কা করছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) একটি প্রতিবেদনে বলেছে, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে এই বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে আগামী ৩ মাসের মধ্যে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাঁদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে যাচ্ছেন। আইএলও আরও বলেছে, বিভিন্ন আয়ের মানুষজন এর ফলে ক্ষতির শিকার হবেন। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি। বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানি খাত, বিশেষ করে পোশাকশিল্পে এরই মধ্যে সংকট দেখা দিয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের ফলে বহু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে তাদের ক্রয়াদেশ বাতিল কিংবা স্থগিত করছে। এদিকে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো রোবটিকসের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা-আইওটি ইত্যাদি ব্যবহার করে অদক্ষ ও অর্ধশিক্ষিত শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে স্থান পূরণ করবে। তেমন হলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম কান্ডারি প্রায় সোয়া কোটি প্রবাসীও যে নিকট ভবিষ্যতে রোবটের কাছে তাঁদের চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসবেন না, সেই শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

করোনাভাইরাস
প্রতীকী ছবি।

এসব কিছুই হতাশার কথা। তবে এর পাশাপাশি আশার আলোও যে একদম নেই, তা কিন্তু নয়। নদীর এক কূল ভেঙে যেমন আরেক কূল জেগে ওঠে, ঠিক সেভাবেই কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীতেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে গড়ে উঠবে বিকল্পধারার ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান। কোভিড-পরবর্তী পৃথিবী কেমন হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও যে বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেওয়া যায় তা হলো, প্রযুক্তিই হবে মূল চালিকা শক্তি। পৃথিবীব্যাপী মানুষ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের প্রয়োজনেই বিকল্প উদ্ভাবন করে নেবে। ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি কীভাবে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানকে বাসা থেকে কাজ করে সচল রেখেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের মূল্যবান সময় ঝরে যেতে দেয়নি। নিত্যপণ্যের কেনাকাটাও মানুষ বাসায় বসেই করতে পেরেছে অনায়াসে। দূরত্ব যতই হোক না কেন, নিকটজনের সঙ্গে যোগাযোগও থেমে ছিল না। আর এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তির কল্যাণে। করোনার প্রভাবে আগামী দিনে কোন ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর সেবা বা সমাধানের চাহিদা বাড়বে? প্রযুক্তিজগতে কেমন পরিবর্তন আসবে? সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোই–বা কোথায়? চলুন জেনে নিই।

টেলিহেলথ/টেলিমেডিসিন

প্রায় দুই দশক ধরে প্রচলিত রয়েছে টেলিহেলথ। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়েও মানুষের মধ্যে এই সেবা গ্রহণের আগ্রহ তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। করোনাভাইরাস মহামারি বিষয়টিকে আমূল পাল্টে দেবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অধিকাংশ করোনা রোগীকে টেলিহেলথের মাধ্যমে চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের মিক্সড রিয়েলিটি হেডসেট ও জেশ্চারভিত্তিক একটি প্রজেক্ট ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি হাসপাতালে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা কিনা এই করোনাসংকটে চিকিৎসক, রোগী ও মেডিকেল স্টাফদের পারস্পরিক সংস্পর্শ এড়িয়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করায় কাজে দিচ্ছে। যদিও টেলিহেলথ বা টেলিমেডিসিনের নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের চাহিদা বিবেচনায় প্রযুক্তিবিদ, উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হলে আধুনিক প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়ে নিকট ভবিষ্যতে হয়তো টেলিহেলথের এই সীমাবদ্ধতাগুলোও কাটিয়ে ওঠা যাবে। অগমেন্টেড রিয়েলিটি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি, রোবটিকসের মতো প্রযুক্তির উৎকর্ষে টেলিহেলথ হয়ে উঠতে পারে সম্ভাবনাময় এক খাত।

অটোনোমাস কমার্স

উন্নত বিশ্বে ই-কমার্সের ধারণা ইতিমধ্যেই পুরোনো হয়ে গেছে। সেই পুরোনো ধারণাকে আরও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে পৃথিবীর তাবৎ ই-কমার্স জায়ান্টরা ড্রোনের মাধ্যমে ডেলিভারি, রোবটের মাধ্যমে বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান, অগমেন্টেড রিয়েলিটির প্রয়োগে পণ্যের প্রদর্শনী ইত্যাদি নিয়ে করোনা–পূর্ববর্তী সময়েই কাজ শুরু করেছিল। সেই পালে এবার জোর হাওয়া দিল কোভিড-১৯। অদূর ভবিষ্যতে ই-কমার্সের সামগ্রিক কার্যক্রম, যথা ক্রেতার অর্ডার প্রদান থেকে শুরু করে পণ্যের ফুলফিলমেন্ট, ডেলিভারি ও পেমেন্ট—সবকিছুই সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ই-কমার্সের জায়গা নেবে অটোনোমাস কমার্স।

ডিজিটাল ও কন্ট্যাক্টলেস পেমেন্ট

ক্যাশের জায়গা চৌকোনা কার্ড কিছুটা দখল করেছিল আগেই। আছে হরেক রকম মুঠোফোন ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, কিন্তু তারপরও কাগজের নোট ব্যবহার করা থেকে মানুষ পুরোপুরি সরে আসেনি কখনোই। তবে এবার মনে হয় দৃশ্যপট পাল্টাবে। করোনাকালে মানুষ চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব নগদ লেনদেন পরিহার করার। এই পরিস্থিতিই সুযোগ করে দেবে ডিজিটাল ও কন্ট্যাক্টলেস পেমেন্টের এক নতুন যুগের সূচনার। স্ট্যাটিসটারের এক হিসাবমতে, বিশ্বব্যাপী ২০২০ সালে ৪ লাখ ৭৬৯ হাজার ৩৭০ মিলিয়ন ডলারের লেনদেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে হবে, যা গত বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন (এনএফসি), কিউআরভিত্তিক সলিউশন, মুঠোফোন অ্যাপ ও বিট কয়েনের মতো ক্রিপ্টো কারেন্সিই হতে যাচ্ছে আগামী দিনের লেনদেনের মাধ্যম, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

দূরশিক্ষণ

অনলাইন স্টাডি, অর্থাৎ ডিসট্যান্ট লার্নিং বা দূরশিক্ষণ নতুন কিছু নয়। আমেরিকার প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। জনপ্রিয় এই শিক্ষাব্যবস্থার দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে ব্রিটেন ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো। তবে এখনো পৃথিবীর অনেক দেশেই দূরশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত ডিগ্রিকে সেভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। অনেক দেশেই চাকরির বিজ্ঞাপনে বিশেষভাবে উল্লেখ করে দেওয়া হয়, যেন দূরশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জিত ডিগ্রিধারী কেউ আবেদন না করেন। তবে করোনার প্রভাবে এখানেও আসবে পরিবর্তন। আর সে পরিবর্তনের মূলে থাকবে প্রযুক্তি। কারণ, নানা রকম প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধানই এই শিক্ষাব্যবস্থার চালিকা শক্তি। মুকস (MOOCS), যা কিনা ম্যাসিভ অনলাইন ওপেন কোর্সেসের সংক্ষিপ্ত রূপ। তাতে শুধু ভিডিও লেকচারের পরিবর্তে প্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগবে। বর্তমানের এলএমএস (LMS) বা লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমগুলোর আরও উন্নত সংস্করণের প্রয়োজন হবে, যাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে ইন্টারঅ্যাকশন আরও বাড়ানো যায়, একই সঙ্গে অ্যাসেসমেন্ট প্রক্রিয়ারও আধুনিকায়ন দরকার হবে। অর্থাৎ এ খাতেও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ছোঁয়া নিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে।

বিনোদন

করোনার এই কঠিন সময় শেষে আবার কখন বিনোদনজগৎ স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে, তা বলা কঠিন। আবার যখন ফিরবে, তখন রোজকার শুটিং, সংগীত, নাটক, সিনেমা ব্যবসা কি সেই আগের মতো হতে পারবে? অর্থনীতির এই টালমাটাল দশায় বিনিয়োগ কি ফিরে আসবে? আপাতত এই লকডাউনে বিনোদনের জন্য বিশ্ববাসী ভরসা খুঁজছে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে। ধারণা করা হচ্ছে, কোভিড–পরবর্তী সময়েও তা–ই হবে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান প্ল্যাটফর্মগুলোর পাশাপাশি আরও নতুন নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হবে। তবে শুধু প্রচার ও পরিবেশনের ক্ষেত্রে নয়, প্রযুক্তির কল্যাণে বদলে যেতে পারে চিরাচরিত দৃশ্য ও সংগীত ধারণের পন্থাও। একটি সম্পূর্ণ নাটক না চলচ্চিত্রের অভিনেতা–অভিনেত্রীরা হয়তো ঘরে বসেই অংশ নেবেন শুটিংয়ে। বিনোদনে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে অগমেন্টেড রিয়েলিটি, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি ও মিক্সড রিয়েলিটির কল্যাণে।

বিপণন ও সরবরাহব্যবস্থা

করোনা–পরবর্তী সময়ে স্বাভাবিকভাবেই পণ্য ও সেবার বিপণনে প্রচলিত ধারার বাইরে ভাবতে বাধ্য হবে প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কনজ্যুমারদেরই মার্কেটে পরিণত করার প্রয়াস দেখা যেতে পারে। পণ্যের বিপণনে ইতিমধ্যেই ব্যবহৃত হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও বিগ ডেটা, যা সামনের দিনগুলোতে বহুগুণে বেড়ে যাবে। অপর দিকে সরবরাহব্যবস্থায় বড় ভূমিকা রাখবে রোবট, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন (আরএফআইডি) প্রযুক্তি, ড্রোন, অটোনোমাস ট্রাক ইত্যাদি। এর পাশাপাশি ইন্ডাস্ট্রিয়াল আইওটির প্রয়োগ বাড়বে সরবরাহব্যবস্থা আধুনিকায়ন ও খরচ কমানোর জন্য।

লেখক
ছবি: সংগৃহীত

ওপরে আলোচিত সেক্টরগুলোতে স্বাভাবিক নিয়মেই প্রযুক্তির উৎকর্ষের ছোঁয়ায় আধুনিকায়ন হওয়ার কথা ছিল। তবে করোনা পরিস্থিতি সেই আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তাকে ত্বরান্বিত করেছে বহুগুণে, যার ফলে তৈরি হয়েছে নতুন ধারার ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা। সময় যত গড়াবে, ততই মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের এই প্রযুক্তিনির্ভরতা আরও বাড়বে। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রয়োজন হবে নতুন নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক সমাধানের। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাত, বিশেষ করে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতের সামনে রয়েছে অপার সম্ভাবনার হাতছানি। সঠিক পরিকল্পনা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে দ্রুততম সময়ে দক্ষ জনবল তৈরি, দেশের সর্বত্র উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রযুক্তি খাতে উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা। সময় ক্ষেপণ না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে এ খাত হয়ে উঠতে পারে দেশের প্রধানতম উপার্জন খাত।

তবে সম্ভাবনার এই ট্রেন আমরা মিস করে যাব, যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী না করা যায়। করোনা–পরবর্তী পৃথিবীতে একাডেমিক ডিগ্রির চেয়ে বরং সুনির্দিষ্ট দক্ষতার কদর বেশি হবে বলে ধারণা করা যায়। আর এই দক্ষতা অর্জনের জন্য কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে বরং নিজেকেই সচেষ্ট হতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনীয় সব রসদই মজুত রয়েছে, শুধু সেগুলোকে যথাযথ ব্যবহারের অপেক্ষা।

কাজী হাসান রবিন: বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ

গবেষণা ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক, প্রথম আলো বন্ধুসভা, জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ

তথ্যসূত্র: আইএলও, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, ফোর্বস