কলেজ হোস্টেলের পাশের রাস্তা দিয়ে স্কুলে আসা–যাওয়া করত টুম্পা। সেই কিশোরী টুম্পা যেন বাগানে সদ্য ফোটা রক্তজবার মতোই স্নিগ্ধ ও কোমল। গত শীতে একটানা ১৭ দিন গোসল না করার পুরস্কার হিসেবে যেই অপুকে বন্ধুরা জোর করে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে গোসল দিয়েছিল। সেই অপুই এই মাঘের শীতে সকাল সকাল গোসলটা সেরে নেয়। বাঁ দিকে চুলের সিঁথি কাটে। বারবার আয়নায় নিজেকে দেখে। মহানায়ক উত্তমকুমারের চেহারার মতো না হলেও ভিলেন ডিপজলের মতো যে তাকে দেখায় না—এটা সে নিশ্চিত। আজকাল অপু টি–শার্টও আয়রন করে পরে। শুধু একবার টুম্পার নেক নজরে পড়ার জন্য কত চেষ্টাই না করছে সে। ছয় মাস ধরে এই অসাংবিধানিক রুটিনের মায়াজালে সে বন্দী। সেই সকাল থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত জিরাফের মতো পড়ার টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে বাইরে মুখ বাড়িয়ে বসে থাকে। তবু এক দিনও টুম্পা তার অভাগা মুখের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি! কপাল পোড়া না হলে কি এমনটা কারও সঙ্গে হয়?
শেষ পর্যন্ত কলেজ হোস্টেলে লাভ গুরু নামে বিখ্যাত আবীরের দ্বারস্থ হয় অপু্। বিরাট হৃদয়গ্রাহী প্রেমের প্রাথমিক পর্বের ইতিবৃত্ত শুনে বন্ধুকে প্রেমের যুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেয় আবীর। কালো ঝড়ে গহিন সাগরে ডুবন্ত মানুষ যেমন সামান্য খড়কুটো পেলে যেই রকম করে, ঠিক সে রকমই অপু যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল।
সকাল সকাল গোসল সেরেই পাঞ্জাবি পরে বসে আছে অপু। মনে হচ্ছে আজ তার ঈদের দিন। খুশিতে গদোগদো করছে সে। কিন্তু আবীর এখনো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। গভীর ঘুমে সে আচ্ছন্ন। আবীরের ওপর অপুর রাগ হচ্ছে খুব। এক বন্ধুর বিপদে আরেকটা বন্ধু কীভাবে এমন করে ঘুমায়! না, এখন রাগ করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আগে যুদ্ধে জয়ী হতে হবে—পরে এসব নিয়ে ভাবা যাবে। অপুর পীড়াপীড়িতে আবীর হেলেদুলে ঘুম থেকে উঠে বসে। অপু তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়—আজ অপু টুম্পাকে প্রপোজ করবে। বন্ধুর সঙ্গে থেকে এই মহান প্রপোজ–যুদ্ধের যাবতীয় রসদ জোগাবে আবীর। সুখেন পালের দোকানের মিষ্টি খেতে খেতে সে রকমই পরিকল্পনা করেছিল দুই বন্ধু।
টয়লেটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অপু। অস্থিরতায় পায়চারির গতি বেড়ে যাচ্ছিল তার। কিন্তু ভেতরে শান্তির কাম সারছে আবীর। দরজায় অপুর ধাক্কাধাক্কিতে চোখেমুখে চরম বিরক্তির ভাব নিয়ে টয়লেট থেকে বের হয়ে আসে আবীর। আবীর রাগে গজগজ করতে থাকে। অপুকে সে বলে দেয় যে সে যেতে পারবে না। কথাটা শুনেই অপুর মনে হলো এই শীতেও যেন তার মাথায় বিশাল আকারের একটা বাজ পড়ল! ইন্না লিল্লাহ পড়ল মনে মনে। এদিকে যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করেছে। অথচ এখন নাকি প্রধান সেনাপতি বলছে—যুদ্ধক্ষেত্রে সে যাবে না। এটা কি ছেলের হাতের মোয়া! বললেই হলো? রাগটা নিজের কন্ট্রোলে নিয়ে নিজেকে বুঝ দেয় অপু। এখন আবীরের সঙ্গে রাগ করা চলবে না। যুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য নানান কৌশল করতে হয়। আবীরের হাতে–পায়ে ধরে শেষ পর্যন্ত আবীরকে সঙ্গে নিয়ে বের হয় অপু। যেন বরযাত্রায় যাচ্ছে দুজন! মিনিট দশেক ধরে পুরাতন মন্দিরের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দুই বন্ধু। এই পথেই আসে টুম্পা। আবীর টুম্পাকে দেখেনি কখনো। অবশ্য কোনো মেয়েকে নিয়ে তার কোনো কৌতূহল নেই। কিছুটা নারীবিদ্বেষী বৈকি। তবে দারুণ সব টোটকা জানে সে। এসব টোটকা প্রয়োগ করে বেশ কয়েকজন প্রেমে সফল হওয়ার জনশ্রুতিও আছে ক্যাম্পাসে।
টুম্পা আসছে। ডান হাতের তর্জনী দিয়ে অপু ইশারায় আবীরকে দেখাল। আবীর চেয়ে আছে টুম্পার দিকে। মেয়েটা কাছে আসতেই আবীর অপুর কাছ থেকে গিফট হাতে নিয়ে তাকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বলল। আবীর টুম্পার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
—এক্সকিউজ মি। একটু দাঁড়াবেন, প্লিজ।
—কেন দাঁড়াব?
—আমার একটা কথা ছিল। অনেক দিন ধরে বলব বলব করে বলতে পারছি না।
—জি, যা বলবেন তাড়াতাড়ি বলেন। ১০টা থেকে আমার পরীক্ষা আছে।
—আমি আবীর। সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট।
—হ্যাঁ। আমি জানি।
—জানি মানে? কীভাবে?
—আপনার বান্ধবী-তানিয়া আপু আমাদের বাসায় থাকেন। ওনার মুখ থেকে আপনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। আর আপুর জন্মদিনে আপনার আঁকা ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে।
—আপনি দেখেছেন! থ্যাংকস গড।
—হুম। এখন বলুন কেন আমার পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন?
—কোনোরকম ভণিতা ছাড়া সোজাসাপ্টা বলছি, আই ফল ইন লাভ। আই মিন...আই লাভ ইউ, টুম্পা।
টুম্পা সেদিন গিফট বক্সটা হাতে নিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে গেল। মেয়েটা প্রজাপতির মতোই ডানা মেলে উড়তে উড়তে চলে গেল চোখের সীমানার বাইরে। দূর থেকে আবীর আর টুম্পার মিনিট পাঁচেকের আলাপনকে অনেক দীর্ঘই মনে হলো অপুর কাছে। কথা না শুনলেও সে এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে সে যুদ্ধে জয়ী হতে চলেছে। মনে মনে সে ভাবছে—আবীর আসলেই জাদু জানে। আবীরকে অপু দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল—
—দোস্ত, কী খাবি ক? আজকে তোর লাইগা সব ফ্রি।
—বি কুল, দোস্ত। আগে পুরোপুরি জয়ী হতে হবে। তারপর উচ্ছ্বাস ও উল্লাস করা যাবে। ওয়েট টিল দ্যাট মোমেন্ট।