পৃথিবীতে কমে আসছে পাখিদের আয়ু

প্রতীকী ছবি।
অলংকরণ: বাবুল হোসাইন সোহাগ

জীববৈচিত্র্যের একটি বিশেষ অংশ পাখি। পাখির সঙ্গে মানুষের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। আমাদের নানা প্রয়োজনে পাখিরা তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রায় সব প্রজাতির পাখিই মানুষের কোনো না কোনো উপকার করে থাকে। অত্যন্ত উপকারী হওয়া সত্ত্বেও দিন দিন কমছে পাখির সংখ্যা। যার জন্য অনেকাংশে মানুষই দায়ী। রোমে ইংরেজি নববর্ষ উদ্‌যাপনে বাজি ফাটানোর দরুন মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য পাখির। রাস্তায় অজস্র মৃত পাখি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ‘ইন্টারন্যাশন্যাল অর্গানাইজেশন ফর দ্য প্রটেকশন অব অ্যানিমেলস’–এর মতে, অত্যধিক শব্দ পাখিদের মৃত্যুর প্রধান কারণ।

আমাদের ভুললে চলবে না, তাদেরও হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হতে পারে। পাখিদের শ্রবণসীমা অন্য প্রাণীদের তুলনায় অনেক কম। ফলে প্রাণিকুলের কাছে বিশেষ করে মানুষের কাছে যেসব শব্দ সহ্যসীমার ভেতরে, পাখিদের জন্য সেসব শব্দ ভয়াবহ, মরণমুখী। শুধু শব্দদূষণই নয়, মানুষের আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ড পাখিদের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। বর্তমানে গাছ কাটা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশি। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষ গাছ কাটছে। এতে করে পাখিদের অভয়ারণ্য নষ্ট হচ্ছে। তারা তাদের থাকার জায়গা হারাচ্ছে, হয়ে পড়েছে আশ্রয়হীন। প্লাস্টিকদূষণ আজকের দিনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। প্লাস্টিক সহজে নিষ্কাশন সম্ভব না বলে এটি মাটিতে, পানিতে বছরের পর বছর থেকেই যায়। মাটি, পানির দূষণ ঘটাচ্ছে এই প্লাস্টিক। শুধু মানুষ বা অন্যান্য প্রাণী নয়, পাখিরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আমরা প্রতিনিয়ত জলাভূমি জবরদখল–সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ পাই। স্থলভাগের পাশাপাশি জলভাগেও রয়েছে পাখিদের বিচরণ। দিন দিন জলাভূমির সংখ্যা হ্রাসের সঙ্গে উজাড় হচ্ছে জলজ পাখিরা। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পাখি হ্রাসের একই দৃশ্য নজরে পড়ে। বাংলাদেশে শীতকালে দেখা যায় পরিযায়ী বা অতিথি পাখিদের অবাধ বিচরণ। সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন হিমশীতল দেশ থেকে পাখিরা এ দেশে চলে আসে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর টানে। কিন্তু হাওর-বাঁওড়ে ব্যাপকহারে মাছ শিকার করে তাদের বিপদে ফেলছে মানুষ। তারা ভুগছে খাদ্যসংকটে। পাখি শিকার নিষিদ্ধ সত্ত্বেও মানুষ পাখি শিকার করে পাচার করছে বিভিন্ন নদী এবং সমুদ্রচর এলাকা থেকে। সে জন্য আশঙ্কাজনকভাবে কমছে পাখিদের সংখ্যা।

বর্তমান বিশ্ব প্রযুক্তিনির্ভর। বিশ্বের উন্নতি সাধন হচ্ছে প্রযুক্তির বহুবিধ ব্যবহারের বদৌলতে। প্রযুক্তির কল্যাণ পেতে যেসব ইলেকট্রনিক ডিভাইস আমরা ব্যবহার করছি, সেসব থেকে প্রতি মুহূর্তে নির্গত হচ্ছে রেডিয়েশন। যত দ্রুততার সঙ্গে আমরা প্রযুক্তির কাঁধে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছি, সেভাবেই বন্য প্রাণী ও পাখিদের ক্ষতি বাড়ছে। কমছে তাদের প্রজননক্ষমতা। বাড়ছে শারীরিক সমস্যা। অতিমাত্রায় রেডিয়েশন পাখিদের দেহকোষ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। টিস্যুগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাখিরা ডিম পাড়তে পারছে না, পারলেও ছানা ফুটছে না। পরিযায়ী পাখিরা পথভ্রান্ত হয়ে পড়ছে, পথ ভুল করে চলে যাচ্ছে নতুন কোনো প্রতিকূল পরিবেশে।

দৈনন্দিন আমরা যা কিছু করছি, তা কোনো না কোনোভাবে পাখিদের ক্ষতি করে। অথচ পাখিরা যুগ যুগ ধরে মানুষের সাহায্য করে এসেছে। চিল, বাজ পাখিগুলো বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রাণী খেয়ে নিয়ে মানুষকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে। খেতখামার, বন–জঙ্গল, ফুল ও ফলের বাগানকে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে পাখিরা। তারা অল্প সময়ে অনেক কীটপতঙ্গ খেয়ে নিতে পারে। একটি ছোট পাখি ঘণ্টায় ১ হাজার ২০০ পোকা ধরে খেতে পারে। কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করে পাখি। ফলে কীটনাশকের ব্যবহারও কম করতে হয়। জৈব উপায়ে স্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎপাদন সম্ভবপর হয়। কৃষকের উৎপাদন বাড়ে। যেহেতু পোকামাকড় শস্য খেয়ে নষ্ট করতে পারে না। তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম হয়, যা আমাদের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে।

গৃহপালিত গরু-ছাগলকেও রক্ষা করে পাখিরা। গরু-ছাগলকে আক্রমণ থেকে বাঁচায়। এদের লোমে একধরনের পোকা বাসা বাঁধে। পাখিরা সেই পোকাও খুঁটে খুঁটে খায়। বিভিন্ন ময়লা, মৃত জীবজন্তু খেয়ে তারা পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখে। দূষণ কম হয়। বিভিন্ন গাছের বীজ এদিক–সেদিক ছড়িয়ে দেয় পাখিরা। ছোট ছোট গাছের বীজ তাদের কাদামাখা পায়ে বা পালকে আটকে যায়। অনেক সময় দেখা যায় পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশের গাছের বীজ বিদেশেও নিয়ে গেছে। পরাগায়নে পাখিরা সবচেয়ে সক্রিয়। তারা যখন খাবার সংগ্রহের জন্য এই ফুল থেকে ওই ফুলে বসে, তখন রেণু তাদের গায়ে লেগে যায়। রেণুমাখা পাখি যখন অন্য ফুলে বসে, তখন সেটি মিশে ফল উৎপাদনের কাজে লাগে।

পাখির এমন আরও উপকারিতা আছে, যা বলে শেষ করা যাবে না হয়তো৷ বিশেষ কয়েকটি প্রজাতি ছাড়া পাখিরা ক্ষুদ্র পরিসরে আমাদের অনেক সহায়তা করে। কিন্তু আমাদের কর্মকাণ্ড তাদের জীবন সংকটে ফেলছে। পরোক্ষভাবে এতে আমরাও প্রভাবিত হচ্ছি, আটকে পড়ছি নিজেদের তৈরি করা সংকটে। কারণ, পাখি আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমাদের সামগ্রিক প্রয়োজনের অংশ বলা চলে পাখিকে। পরিবেশে যেহেতু পাখিদেরও অংশীদারত্ব আছে, তাই পাখি ছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়। প্রকৃতির সৌন্দর্যের অংশ এই পাখি। আর প্রকৃতির সৌন্দর্যে আমরা আপ্লুত হই। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে, পরিবেশের ভারসাম্যের তাগিদে পাখির হ্রাস কম হওয়া উচিত। সুন্দর এবং পাখিদের বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে আমাদের উচিত যথাসম্ভব পরিবেশবান্ধব আচরণ করা। পৃথিবী বন্য প্রাণী ও পাখিদের হোক। আমাদের পৃথিবী সুন্দর হোক।