ভোরের দিকে বৃষ্টি হওয়ায় শীত শীত ভাব। ফালুর বউ রেশমার ভেতর সেসব অনুভব হচ্ছে না। চৈত্র মাসের কড়া গরমের মতো মেজাজ, দরাজ গলা। ঘুম থেকে উঠে প্রথম কথা, এখনো লাশের মতো পড়ে আছে। ঘরে তেল নেই, চাল নেই।
ফালু লাশ নয়, জলজ্যান্ত মানুষ। লাফ দিয়ে উঠে চোখ মুছতে মুছতে বলে, তোমার যে মেজাজ, তাতে তেল না খাওয়াই ভালো।
রেশমা ফালুর কথা শুনে কান্না শুরু করে দিলো। এই মহিলার বড় যোগ্যতা রাগ, হাসি, কান্না তিনটি জিনিস প্রায় একসঙ্গে করতে পারে। এসব গুণ সাধারণত পাতি শ্রেণির নেতাদের ভেতর থাকে। এই রাগ তো নিমেষেই পা জড়িয়ে ধরবে, পা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসবে। রেশমা বেগমকে নেতা নেতা মনে হয়। পাতিনেতা। ফালু সান্ত্বনার সুরে বলে, কাঁদছ কেন?
রেশমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, কেন কাঁদি জানো না? প্রতিদিন রাস্তায় হাঁকডাক শুনি মাছ, মাংস, লিচু, আম, কাঁঠাল, বেদানা, পেয়ারা, লাউ। বর্ষা এসে গেল, একটা কিছু চোখে দেখলাম না। হঠাৎ করে গলার স্বর পরিবর্তন হয়। চোখ দুটো লাল হয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলে, ১০ বছরের সংসার, কী পেলাম? তেল নেই, মরিচ নেই। একটা ডিম ভাজি করে খাব, তারও উপায় নেই। সংসারের নিকুচি করি।
রেশমাকে এখন আর নেতা মনে হচ্ছে না। মনে হয় ভূতে ধরা রোগী। ফালুর আর বসে থাকা ঠিক নয়। সে একটা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়ে। বাজারের পাশে চায়ের দোকানে এক কাপ চা খেতে ঢোকে। এখানে জহির সাহেব চিৎকার দিচ্ছেন। বিষয়—বিশ্ব। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বোঝাচ্ছেন। কথার ভেতর ফালু যোগ দেয়, বর্ষা আসবে আসবে করছে, এখনো আসছে না।
ফালুর কথা শেষ না হতেই জহির সাহেব ধমকের সুরে বলেন, এই ব্যাটা, বর্ষা আসবে মানে! বর্ষা কিসে আসবে বল, বাস, ট্রেন, প্লেন না রকেটে?
হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত ধমকে ফালু কেঁপে ওঠে। তার হাতে থাকা চায়ের পেয়ালা ঝনঝন শব্দে নিচে পড়ে গেল। কাঁপা–চাপাগলায় বলে, বর্ষা কি এগুলোতে আসে! বর্ষা মানুষ নাকি!
ফালুর মানুষ শব্দে জহির সাহেবের রাগ আরও বেড়ে যায়। লাল চোখে বলেন, মানুষ আছে কেউ, মানুষ কই?
- এই যে আপনি মানুষ, আমি গরু।
-তুই গরু, তোর বাকি পা দুটো কোথায়? লেজ কোথায় রেখে এসেছিস?
জহির সাহেব শান্ত হন না। তাঁর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও দুজন। তাদের গায়ের ওপর গরম চা ছিটকে পড়ায় তারা প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত। সমানে বলছে, শালা বেকুব কোথাকার। একটা থাপ্পড় দেব। ধেয়ে ধেয়ে আসছে। ফালু দিশাহারার মতো বলে—হ, আপনারা যেটা বলবেন, সেটাই ঠিক। গেলাম।
- গেলাম মানে! সুন্দর করে বল, চললাম।
জহির সাহেবের হাবভাবে মনে হয়, তিনি পায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করার মানসিকতা নিয়েই এখানে বসেছেন। যে আসবে তার সঙ্গেই ঝগড়া করবেন। কথা বললেই তার একটা ভুল বের করবেন। কিছু ডিগ্রি থাকায় মানুষকে মানুষ মনে করেন না। আগে ছিলেন কলেজপ্রধান। সবাই স্যার বলত। স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা ছেড়ে পদ চেয়ে দলে যোগ দিয়েছেন। পদের জন্য, পদের মোহে দল। এখন কেউ স্যার বলে না, নেতা বলে ডাকে। আগে একা একা পথ চলতেন, এখন তাঁর চারপাশে বডিগার্ড থাকে। চায়ের দোকানেও বডিগার্ড আছে। তারা ফালুর দিকে লাল চোখে তাকাচ্ছে।
ফালু চা খেতে এসে পড়েছে এক মহাবিপদে। সাগরে কখন ঝড় ওঠে, ফালুর মতো সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের সেটা জানার কথা নয়। বাঁচার একটাই উপায়, এখান থেকে ভোঁ–দৌড় দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। ভাবনার সঙ্গেই সঙ্গেই পকেটমারের চুরি করে মরিয়া হয়ে দৌড়ে পালানোর মতো করে পালিয়ে যায় ফালু। বাজারের ভেতর মানুষ কিলবিল করছে। থরে থরে সাজানো কত কিছু। একেকটার দাম শুনে একেকবার কেঁপে ওঠে। পাশের একজন বলে—ভাই, আপনার কি মৃগী ব্যারাম আছে?
ফালু অবাক হয়ে বলে—কই, না তো। তবে আমার বউয়ের আছে। রেশমা। ভূতে ধরা ব্যারামও আছে।
- বারবার কেঁপে উঠছেন কেন?
- দাম শুনে কেঁপে উঠছি। আপনার পকেটে টাকা না থাকলে আপনিও কেঁপে উঠতেন।
চড়া দামের ব্যাপারে লোকটা ফালুর সঙ্গে একমত হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, তেল, চাল, আটা, মাংস তো নয়, সব যেন আগুনের দলা। চাকরি না করে যদি নেতা হতে পারতাম!
জহির সাহেব এখানে থাকলে নিশ্চয়ই বলতেন, এই গাধা, বাজারভরা আগুনের দলা নিয়ে মানুষ বসে আছে? নেতা হবে—ইস, নেতা হওয়া যেন মুখের কথা।
বড় একটা দোকান দেখে ফালু দাঁড়ায়। বড় দোকানে দাম কম হতে পারে। দাম শুনে আবার কেঁপে ওঠে ফালু।
দোকানদার হাসিমুখে বলে, ভাই হুট করে দাম বাড়াতে কী যে উপকার হইছে বলার নয়। প্রতিজ্ঞা করেছি, ছেলে হোক আর মেয়ে হোক নামটা তেল রাখব, সয়াবিন। ছেলে হলে সয়াবিন আলী, মেয়ে হলে সয়াবিনা খাতুন।
বাইরে শোরগোল শোনা যায়। কৌতূহল নিয়ে ফালু বাজার থেকে বের হয়। অনেক মানুষের জটলা। নেতা জহির সাহেবকে ধরা হয়েছে। হাতে হাতকড়া। লোকজন বলছে, সিন্ডিকেটে জড়িত। সিন্ডিকেট কী! যে কেটই হোক, জহির সাহেব বিপদে পড়েছেন, সেটা তাঁর চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। টেনেহিঁচড়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া দেখে ফালু বিড়বিড় করে বলে, তাঁর ব্যবহার ভালো নয়। এ জন্য পদও কখনো বিপদের কারণ হয়।