নিয়তি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হাতের ব্যাগটা রেখে টংদোকানের একটা বেঞ্চে বসলাম। সিলেটে এসেছি আরও তিন দিন আগে। এই তিন দিনে মনে হয় এত দিন বইতে পড়া ‘প্রলয়’ নিজের চোখে দেখলাম। বাড়ির চালের ওপর পর্যন্ত পানি। যেন মানুষের এত দিনের বসতি একটি সাগরে পরিণত হয়েছে।
কথা ছিল এসে আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু অর্থ দান করে আর এক বেলা থেকে কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে ফিরে যাব, জর্নালে লিখব। কিন্তু সেই এক বেলায় যা দেখনাম, শুনলাম, তার পরে যদি চলে আসতাম, নিজেকে একদম বিবেকহীন মনে হতো। এই তিন দিনে আশ্রয়কেন্দ্রে সবাইকে সেবা করার চেষ্টা করলাম। এক কাজ শেষ করতে না করতেই চলে আসে আরেক কাজ। মানুষের সামান্য ব্যাগপত্র বহন করে দেওয়া, আশ্রয় নেওয়ার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা, সবাই খাবার পাচ্ছে কি না, তা দেখা।
তিন দিনে এই প্রথম আমার হাতে কোনো কাজ নেই। এখানের প্রায় সবাই আমাকে চিনে গেছে। সবাইকে এই বেলায় খাওয়ানো শেষ করে দোকানদারের থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিলাম।

হঠাৎ চোখে পড়ল একটু দূরে তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। একটি ছেলে ও দুটি মেয়ে। ছেলেটিকে দেখে মনে হয় বয়স পাঁচের কাছাকাছি। ছোট মেয়েটিরও মনে হয় তা–ই। আবার ছয়ও হতে পারে। অন্য মেয়েটির বোধ হয় আট বা নয় বছর বয়স। সম্ভবত ভাইবোন। পরনের জামা দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন ধোয়া হয়নি। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল আর্থিক অবস্থা ভালো না। অনেক দিন খেতেও হয়তো পায়নি।
নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। অস্পষ্টভাবে হলেও শুনতে পাচ্ছিলাম।
ছেলেটা বলল, ‘দিদি, আমরা খাব কখন? সবাই তো খাওয়া শেষ করে চলে গেল। ওনারও তো মনে হয় খাওয়া শেষ।’ সম্ভবত আমার কথাই বলছিল। বড় মেয়েটা বলে, ‘এই একদম না। মা কতবার করে বলেছে অচেনা লোকের থেকে কিছু না নিতে। ওনাকে তো আমরা চিনি না।’
‘কিন্তু ওর থেকে যে সবাই খাচ্ছে। দেখে ভালো লোক বলেই তো মনে হচ্ছে,’ ছোট মেয়েটা বলল।
‘মনে নেই, মা বলেছিল পাশের বাড়ির তিনির সাথে না খেলতে? আমাদের ফুল তুলে এনে দিত বলে আমরা তো তাও খেলতাম ভালোভেবে। নেহাত টাকা আছে বলে ওদের রুপার মূলের ডালাটা হারিয়ে যাওয়ার পর আমাদের বিনা দোষে কত দোষারোপ, কত অপমান করল? মা যা বলে, তাই ঠিক হয়। আমরা কাউকেই বিশ্বাস করতে পারব না রে।’
‘আচ্ছা, দিদি। খাব না।’ মুখ কিঞ্চিৎ ভার করে ছেলেটা বলল।
কথা শুনে ওদের জন্য আমার কষ্টই লাগল। বেচারা ছেলেমেয়েগুলো একটা ভুলের জন্য কতকিছুর মুখোমুখি হচ্ছে। কিন্তু ওদের বাবা-মার তো বোঝার কথা যে আমার অসৎ উদ্দেশ্য নেই। তারা কেন তাহলে ওদের খেতে নিয়ে এল না?

একবার ভাবলাম যাই ওদের গিয়ে বুঝিয়ে বলি যে আমি সাহায্য করতেই এসেছি। কিন্তু কী যেন ভেবে আর গেলাম না।
আশ্রয়কেন্দ্রটি আসলে ছিল চারতলা একটি স্কুল। চায়ের দোকানটা স্কুলের একদম সামনেই। চা-বিস্কুট খেয়ে আবার স্কুলে ঢুকলাম। সামনের বারান্দা দিয়ে রাস্তা দেখা যায়। চায়ের দোকানটাও। বাচ্চাগুলো তখন আর দূরে নেই। দোকানের বেঞ্চেই বসে আছে।
বারান্দায় দুজন মধ্য বয়স্ক মহিলা দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। প্রথম মহিলাটি ওই তিনজনকে ইঙ্গিত করে দ্বিতীয় মহিলাটিকে বললেন, ‘বাচ্চা তিনটের জন্য বড় খারাপ লাগে রে। কী করবে বুঝিয়ে দেওয়ার লোক নেই। ওদের যে খেতে হবে, তা–ও বুঝতে পারছে না।’
‘সত্যিই তাই,’ দ্বিতীয় মহিলাটি বললেন, ‘একেই বলে নিয়তি। বাবা ছেড়ে চলে গেল জন্মের পরপরই। বোধবুদ্ধি হওয়ার আগেই এই বন্যা মাকে কেড়ে নিল। কোথায় যে যাবে এরা!’

এখন বুঝতে পারলাম কেন ওরা খেতে আসতে পারেনি। নিজে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে সবার সঙ্গে চলা যাবে না, সবার সঙ্গ নেওয়া বা দেওয়া যাবে না, সেই শিক্ষা তো তাদের মা দিয়েছে। কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে, ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্যই যে আবার মাঝেমধ্যে অচেনা মানুষের সাহায্যও নিতে হয়, সেই শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ আর হয়নি। তার আগেই এই নিষ্ঠুর প্রকৃতি তাদের মাকে কেড়ে নিয়েছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ভিকারুননিসা নূন স্কুল