নিরুদ্দেশ

প্রতীকী ছবি
প্রথম আলো

এক
সোহেলের ব্যবসাটা বলা যেতে পারে চব্বিশ ঘণ্টার। সকালে ব্যবসা না জমলে বিকেলে, বিকেলে না জমলে রাতে—এই সূত্রেই চব্বিশ ঘণ্টা। লোভাতুর চকচকে চোখ নিয়ে কারওয়ান বাজারের জ্যামে জীবিকার অন্বেষণ চাট্টিখানি কথা নয়। মিনিট দশ-পনেরোর জ্যামে বন্দী মানুষগুলো যখন জীবনের হিসাব মেলাতে গিয়ে বিভ্রমে পড়ে যায়, সোহেল তখন এটাকেই মওকা হিসেবে নেয়। সতর্ক দৃষ্টিতে সে তার শিকার খুঁজে বের করে। সিগন্যাল বাতিটা লাল থেকে হলুদে পরিবর্তন হলে জ্যামের গাড়িগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে। সোহেল পা টিপে টিপে বড় ফুটপাতটা ছেড়ে গাড়ির ফাঁকফোকর গলে শিকারের দিকে এগোতে থাকে। শিকারের ঠিক কাছাকাছি গিয়ে একবার ঈশ্বরের নাম নিয়ে পকেটে ভাঁজ করা চাকুটা বের করে মুহূর্তেই বাইকের পেছনে রাখা ব্যাগটার বাঁধনগুলো কেটে দেয়। এরপর চোখের পলকে ছোঁ মেরে ব্যাগটা টান দিয়ে এক দৌড়ে বিপরীত লেনের রাস্তাটাও পেরিয়ে যায় ও। ততক্ষণে জ্যাম ছেড়ে দেয়। শিকার হওয়া ব্যক্তির আর কিছুই করার থাকে না।

রাস্তার এই পাশটায় মরিয়ম অপেক্ষা করে ওর জন্য। ব্যাগটা মরিয়মের হাতে দিয়ে দ্রুত সোনারগাঁ সিগন্যালটা পার হয় ওরা। ব্যাগ মেয়েমানুষের হাতে থাকলেই বেশি নিরাপদ। লোকজন সন্দেহ করে কম। একটা নির্জন জায়গা খুঁজে ব্যাগটার অস্ত্রোপচার করে ওরা। এরপর প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতিয়ে ব্যাগটা ফেলে দ্রুত চম্পট দেয়। রাত বাড়লে মগবাজার কিংবা মৌচাক ফ্লাইওভারের নিচে গুটিয়ে রাখা পলিব্যাগটার ভাঁজ খুলে ঘুমায় ওরা। আগে ওভারব্রিজের ওপর ঘুমালেও ইদানীং ওতে পুলিশের ঝামেলা বেড়ে যাওয়ায় এই–ই সই।

মরিয়মের সাথে ওর সম্পর্কটা সোহেল ঠিক নিজেও ভালোমতো বুঝে উঠতে পারে না। একদিকে মরিয়ম ওর পেশাজীবনের সঙ্গী। আবার এই মরিয়মই ওর তেত্রিশ বসন্তের পর পাওয়া একমাত্র নারী শরীর।

দুই
একটা সময় সোহেল হাত সাফাইয়ের কাজ করত। সেই কাজে লাভের অঙ্কটাও কম ছিল না। দান ঠিক জায়গায় পড়লে কোটিপতি! ভুল জায়গায় পড়লেও হারানোর কিছু নেই। নির্ভার ব্যবসা। তবে সমস্যাটা আরেক জায়গায়। হাত সাফাইয়ের কাজটা অনেকটা জীবন-মরণ খেলার মতো।

হাত সাফাইয়ের কৌশলটা ও রপ্ত করেছিল গুরু ‘কাটা রহিমে’র কাছ থেকে। ব্যবসার শুরুতে গুরুর সাথেই থাকত ও। একটু হাত পাকানোর পর নিজেই এই ব্যবসায় নামে। এটাই এই ব্যবসার অলিখিত নিয়ম। সেই ‘কাটা রহিম’ যখন সায়েন্স ল্যাব মোড়ে বড় একটা দান গোছাতে গিয়ে গণপিটুনিতে মারা গেল, সোহেল সেই দিনই গুরুকে সম্মান দেখিয়ে সেই ব্যবসাটা ছেড়ে দিল।

এরপর কিছুদিন সিএনজির পেছনের কাভার কেটে কিংবা রিকশার সামনে-পেছনে থেকে হাতটানের চেষ্টা করেছে ও। খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। একবার ইডেন কলেজের সামনে রিকশার পেছন থেকে এক মেয়ের ব্যাগ টান দিয়ে গন্ডগোলটা প্রায় পাকিয়েই বসেছিল। ব্যাগ তো গোছাতে পারেইনি উল্টো সেই মেয়ে জুতো খুলে ওকে অনেক দূর পর্যন্ত দৌড়ে নিয়েছিল। ভাগ্যিস সেদিন ধরা পড়েনি। ধরা পড়ার ফলাফলটা কী হতে পারত, তা ভাবলে এখনো গা শিউরে ওঠে।

এরপরই সোহেল ওর পেশার ধাঁচটা পরিবর্তন করে ফেলে। সেই থেকে ও কারওয়ান বাজারের এই পেশায় আছে। তা–ও চোখ বুজে চার-পাঁচ বছর হয়ে গেল। এটা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। তা ছাড়া এই কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় সে জানে জনতার হাতে ধরা পড়ার পর পুলিশের হাতে যত তাড়াতাড়ি নিজেকে সঁপে দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। এতে শারীরিক ক্ষতির আশঙ্কা কমে যায়। সে জন্য সোহেল তার ব্যবসার খদ্দেরগুলো যতটা সম্ভব পুলিশ বক্সের আশপাশেই ধরার চেষ্টা করে।

গত কয়েক বছরে সে একবারই থানায় গিয়েছে। সেবার মরিয়ম গিয়ে থানার বড় সাহেবের কাছে কেঁদেকেটে ওকে ছাড়িয়েছে। এই ঘটনার পর থেকে ওর জীবনে মরিয়মের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। বড় সাহেব অবশ্য ছেড়ে কথা বলেননি। গালের ওপরে এত জোরে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন, যে ব্যথায় সে তিন-চার দিন ভালোভাবে ভাত চিবাতে পারেনি। সেটা ওর কাছে বড় কোনো ঘটনা নয়। জন্মের পর যে কোমল মানবশরীর জীবিকার প্রয়োজনে দ্রুত শক্ত হওয়ার তাড়না নিয়ে বেড়ে ওঠে, সেই জীবনের ইতিহাসে এমন দু–চারটা চড়-থাপ্পড় মনে রাখার মতো বড় কোনো ব্যাপার নয়।

তিন
আজ সারাটা দিন একটানা বৃষ্টি আর হালকা ঝড় হয়ে গেল। রাস্তাগুলো হাঁটুপানিতে ভরে গেল। একটু বৃষ্টি হলেই সোহেলের ব্যবসায় ভাটা পড়ে। মানুষজন রাস্তায় বের হয় কম। ফাঁকা রাস্তায় ধান্দাটা খুব একটা জমে না। আর এতে ঝুঁকিটাও থাকে বেশি। সকালটা অভুক্ত থেকে দুপুর গড়িয়ে এলে মরিয়ম হাঁড়িতে ভাত ফুটাতে দেয়।

ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে অলক্ষুণে বৃষ্টিটা থামি থামি করে থেমে গেল। সন্ধ্যাটা একটু গাঢ় হয়ে এলে সোহেল কারওয়ান বাজারের রাস্তায় নেমে গেল। মরিয়ম আজ ওকে সঙ্গ দিল না। ওর শরীরটা এই কয়েক দিন ভালো যাচ্ছে না।

কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে দুই ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়েও আজ সুবিধা করতে পারল না সোহেল। মনে মনে আজকের মতো ইস্তফা দিয়ে হাঁটতে শুরু করল ও। বাংলামোটরে বাঁক নিয়ে একটু সামনে এগোতেই সোহেল দেখল রাস্তার ঠিক ওপাশেই বড় গোডাউনটার নিচে একটা পিকআপ থেকে মাল নামানো হচ্ছে। শ্রমিকেরা একটা একটা করে বাক্স ভেতরে নিয়ে যাচ্ছেন। সোহেলের ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। গামছাটা কোমরে শক্ত করে বেঁধে স্বাভাবিক হাঁটার গতিতে রাস্তা পেরিয়ে গোডাউনের নিচে এল। হাঁটতে হাঁটতে পিকআপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটা বাক্সে ঝাঁকুনি দিয়ে দেখল। বাক্স বেশ ভারীই ঠেকলো। ভেতরে ভারী কিছুই আছে মনে হচ্ছে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়াল সোহেল। একজন শ্রমিক বাক্স নিয়ে আবার ভেতরে চলে গেল। চারদিকটা একবার সতর্ক চোখে দেখে নিয়ে একটা বাক্সে অভিজ্ঞ দুই হাত গলিয়ে দিল ও। বাক্সটা যতটা ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি ভারী। পিকআপ থেকে নামাতে গিয়ে বেশ বেগই পেতে হলো ওর। বাক্সটা নামিয়ে ওর মনে হলো কোথাও একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। এত ভারী বাক্স নিয়ে দৌড়ানো চাট্টিখানি কথা নয়। অগত্যা বাক্সটা মাথায় চাপিয়েই হাঁটা শুরু করল। কিছু দূরে গিয়ে একটু আড়ালে গলির মুখটায় ঢুকে বাক্সটা মাথা থেকে নামাল। উদ্দেশ্য ভেতরে কী আছে খুলে দেখা। বাজারে না বিকোলে এত ভারী জিনিস মাথায় বয়ে নেওয়ার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া এত সুন্দর প্যাক করা বাক্স দেখলে মগবাজার মোড়ে পুলিশ সন্দেহ করে বসতে পারে।

ভাঁজ করা চাকুটা বের করে সোহেল যেই বাক্সটায় একটা পোঁচ মেরেছে, ওমনি চার-পাঁচটা ছেলে ওর ওপর হামলে পড়ল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কিল-ঘুষি-লাথিতে সোহেলের পেটা শরীরটা লাল হয়ে গেল। জায়গায় জায়গায় ছড়ে গেল, নাক-মুখ ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। সোহেল প্রমাদ গুনল। এই অন্ধকার গলিতে পুলিশের দেখা পাওয়ার সুযোগ কম। আরও বিশ-ত্রিশ মিনিট সোহেলকে সাধ্যমতো পিটিয়ে ওকে এভাবেই ফেলে গেল ওরা। গুরু ‘কাটা রহিম’ বলত, ‘মাইর খাইলে বেশি খাইবি, তাইলে ম্যালাগুলা যন্ত্রণা একলগে হইব। শরীর কষ্ট বুঝব কম।’ গুরুর কথাই ঠিক। শরীরের হাজারটা যন্ত্রণা এক হয়ে একটা অনুভূতিশূন্য পিনপতন নীরবতা পেয়ে বসেছে ওকে। শুধু একটু পর পর মগজটায় একদলা রক্ত ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে বারবার। সোহেলের মনে হলো, ও আর বাঁচবে না। এরপরও গোঙাতে গোঙাতে দুই হাতে যতটা সম্ভব ভর দিয়ে নিজেকে গলিটার বাইরে আনার প্রাণপণ চেষ্টা করল ও। একটা সময় শক্তি নিঃশেষ হয়ে এলে হাল ছেড়ে দিল।

চার
না, গুরুর মতো অদৃষ্ট সোহেলের হয়নি। সেই রাতে শরীরটা কয়েক জায়গায় ভেঙে গেলেও প্রাণে বেঁচে গেল সোহেল। হাসপাতালের নোংরা মেঝেতে অনেক কষ্টে চোখ খুলল ও। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা, চোখে-কানের নিচে এখনো কালো রক্ত জমাট বেঁধে আছে। পাশেই লাঠি হাতে এক পুলিশ কনস্টেবলকে দেখে ভরসা পেল সোহেল। কনস্টেবলের বিরক্তিকর চাহুনি উপেক্ষা করে রক্তজমাট কালো ঠোঁটটা একটু ভাঁজ করে হাসল ও।

আর দুই দিন হাসপাতালে কাটিয়ে থানায় নেওয়া হলো ওকে। সেদিনই পত্রিকায় ছবিসুদ্ধ রিপোর্ট ছাপা হলো, ‘কারওয়ান বাজারে দিনদুপুরে ছিনতাই-চুরি করা সেই সোহেল আটক’।

পাঁচ
সোহেল ছাড়া পেল আরও মাস কয়েক পর। হাজত থেকে বের হয়ে একটা নাপিতের দোকানে ঢুকে চুলটা ঠিক করে আবার বেরিয়ে পড়ল ও। কারওয়ান বাজার নয়, মগবাজারের উদ্দেশে। ফ্লাইওভারের নিচে এসে মরিয়মকে কিছুক্ষণ খুঁজল ও। পেল না। অগত্যা ওখানেই বসে পড়ল সোহেল। মরিয়ম কোথায় আছে বা থাকতে পারে সোহেলের কোনো ধারণা নেই। এই শহরের নাগরিক খাতায় ওদের কোনো পরিচয় থাকে না বলে নিরুদ্দেশ ওদের হাজিরা নেওয়ার প্রয়োজনবোধও কেউ করে না।

তখন বেলা পড়ে এসেছে প্রায়। অফিস ছুটি হয়ে গেছে সব। রঙিন শহরের লাল-নীল বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে আবার। বর্ণিল এই শহরে অচ্ছুত এক অন্ধকারের নিচে বসে সোহেল স্মৃতি হাতড়ায়। বড় সাহেবদের দামি গাড়িগুলোর হেডলাইটের তীব্র আলো একটু পরপরই ঠিকরে পড়ে সোহেলের গায়ে। আলো–আঁধারির এই খেলায় নিজের নির্লিপ্ত শরীরটাকে সঁপে দিয়ে একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ও। চোখের আঠালো জল ততক্ষণে চিকুকে গড়িয়ে চিকচিক করছে। এ জলের গভীরতা মেপে দেখবার সময় এ শহরের কোনো দিন হয়ে ওঠেনি।

(২৩ জুন ২০২০ প্রথম আলো অললাইনে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘কারওয়ান বাজারে দিনে-দুপুরে ছিনতাই-চুরি করা সেই সোহেল আটক’। শিরোনামটা পড়ে মনে হলো সোহেলের জীবনেরও একটা গল্প আছে। তাই লিখতে বসা)