নিতুর বিয়ে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মতি মিয়া সারা দিন অফিস শেষে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরতেই নিয়ম করে দুজন মানুষ ছুটে আসে। স্ত্রী রোজিনা ও তার মা সালেহা বেগম। দিন যত গড়াচ্ছে বিষয়টি ততই ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। আগে দুজন আগপাছ করে এলেও ইদানীং আসছে একসঙ্গে। দাবানল ধেয়ে আসার মতো। একজন ক্রুজ মিসাইল হলে অন্যজন ব্যালিস্টিক মিসাইল।

শহরে অন্য কোনো বাড়ি থাকলে মতি মিয়া সেখানে গিয়ে উঠতে পারতেন। সেটা যেহেতু নেই, এখন বিকল্প পরিকল্পনা বাড়ির সামনে সুরক্ষিত বাংকার খনন।
কলবেল টিপবেন, একসঙ্গে ছুটে আসবে মানুষরূপী দুটি অগ্নিগোলা। মতি মিয়া টুপ করে বাংকারের ভেতর ঢুকে পড়বেন। বিস্ফোরক শব্দের ইতি টেনে তাঁরা নিজ নিজ অবস্থানে ফেরত গেলেই তিনি ঘরে ঢুকবেন।

এটা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে নিতান্ত সহজ–সরল মতি মিয়াকে প্রতিদিন নির্মম এক গৃহযুদ্ধের মারপ্যাঁচ ঘিরে ধরছে। ঘরে ঢুকতেই মা ছুটে এসে বলবেন, ‘প্রায়ই তো পেপারে আসছে ছেলের হাতে মা খুন। এগুলো কেন হয়! তোর বউয়ের মতো দজ্জাল মহিলার কারণে।’
সঙ্গে সঙ্গে রোজিনা চিৎকার করে উঠবে, ‘কী আমি দজ্জাল মহিলা!’
—শুধু দজ্জাল না ডাইনি, রাক্ষসী, পেত্নী, মানুষখেকো...
—তোমার মাকে সামলাও? আমার প্রতিশোধ কিন্তু বিপর্যয় ঢেকে আনবে।

অধিকাংশ দিন ঘটনাগুলো সামাল দেয় রিয়াজ। মতি মিয়ার বড় ছেলে হওয়ায় আপাতত তাঁর ঘাড়ের ওপর এ গুরুদায়িত্ব চেপে বসেছে। বড় বিষয়, সামনে তাঁর বিয়ে। নিতুর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলা সম্পর্ক বিয়ের মাধ্যমে পূর্ণতা পাবে। পারিবারিক অবস্থা স্থিতিশীল না হলে মেয়ে পক্ষ এ বিয়েতে আপত্তি তুলবে। দেখাদেখি পর্বে নিতুর বাবার এক প্রশ্নে প্রায় প্যাঁচ লেগে গিয়েছিল।
—ছেলে কী করে?
—অ্যাডমিন।
—কোম্পানি না সরকারি প্রতিষ্ঠান?
—একটা ফেসবুক গ্রুপের।
শুনেই নিতুর বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এই রকম একটা ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেব! হতেই পারে না।
নিতুর বাবার মুখ সিটকানো দেখে মতি মিয়া কেওক্রাডংয়ের মতো স্থির থাকলেও রিয়াজের মা রোজিনা বেগম জ্বলে ওঠেন, ‘ইশ্‌ হতেই পারে না! ছুঁচোর মতো মুখ করে যেভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে দুনিয়াতে একটাই মাত্র মেয়ে আছে...’
—কী বললেন?
—ছুঁচো বলেছি। গায়ে বিশ্রী কটু গন্ধ।
—আমি ছুঁচো?
—পুরোপুরি নিশ্চিত হতে গায়ের গন্ধ শুঁকে দেখতে হবে।
নিতুর বাবা মাঝারি ধরনের একটা লাফ দিয়ে তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বেরিয়ে যান।

ঘটনার পর যা করার নিতুই করেছিল। অর্ধেক ঘুমের বড়ি খেয়ে মুখে ফেনা তুলে চিৎকার। তারপর চোখ বন্ধ করে নিথর। বাবা হয়রান হয়ে নিতুকে ক্লিনিকে নিয়ে যান। মুহূর্তের মধ্যেই ডাক্তার–নার্স ছুটে আসেন।
—কী হয়েছে?
—বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।
—বিয়ে তো ভালো কথা। তা এ মেয়ের মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে কেন?
নিতুর বাবা মিনমিন করে বলেন, আমি বিয়ে ভেঙে দিয়েছি বলে...
ডাক্তার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সুইসাইড কেস! বেঁচে আছে না মরে গেছে কে জানে? দ্রুত ভেতরে নাও। ওয়াশ করতে হবে।
নিতুকে ভেতরে নেওয়া হয়। কাচের ঘরে একগাদা মেশিন। ডাক্তার সাহেব একটু ঝুকে নিতুর গলার ভেতর পাইপ ঢোকানোর সময় নিতু ফিসফিস করে বলে, আপনি কি পাগল হয়েছেন?
ইলেকট্রিক সর্টে মানুষ যেমন ছিটকে যায় ডাক্তার সাহেব তেমনি ছিটকে যান। পাশে থাকা অক্সিজেন সিলিন্ডার ও পাইপে জড়িয়ে ফ্লোরে আছড়ে পড়েন। সিলিন্ডার পড়ার বিকট শব্দ, সেটা তাঁর গায়ে পড়লে নির্ঘাত মারা পড়তেন, এসব ভাবনায় আসে না। তিনি কেবলই ভাবেন, বিষ খেয়ে মরা মানুষ ভূতপ্রেত হয়। তাঁর সামনে একটা পেত্নী মেয়ে। মরে গিয়ে কথা বলে! ভূত–পেত্নী নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা ভালো নয়। কোনো রকম দাঁড়িয়ে পড়িমরি করে বেরিয়ে যান।

ভেতরে থাকা দুজন নার্স–ডাক্তার সাহেবের চলে যাওয়া পথের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার চলে যাওয়ায় চিকিৎসার দায়িত্ব পড়েছে তাঁদের ঘাড়ে। আর যা–ই হোক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষ ফেলে চলে যাওয়া অমানবিক।
তাঁরা নিতুর দিকে চোখ ঘোরাতেই দেখে মেয়েটা উঠে বসেছে। এবার নার্সদের মুখ শুকিয়ে আসে। বিষ খেয়ে মুখে ফেনা তোলা অচেতন রোগী উঠে বসেছে! দৌড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই কথা বলে নিতু, আপনারা ভয় পাবেন না। আত্মহত্যা মহা অন্যায়। সে কাজ আমি করতে যাব কেন? তা ছাড়া সামনে আমার বিয়ে। আমি রিয়াজকে চাই।
প্রবীণ নার্স তো তো করে বলেন, আপনার নাম কি শাবনুর?
—না, আমার নাম নিতু। আপনারা আমার একটা উপকার করুন প্লিজ।
—বলুন, কী উপকার?
—আমার বাবাকে গিয়ে বলবেন মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে। সে রিয়াজকে দেখতে চায়।
নিতুর পরিচ্ছন্ন কথায় নার্স দুজনের ভয় দূর হয়।
বাইরে অপেক্ষমাণ উদ্বিগ্ন বাবা-মা। নিতুর ভাই ফরিদও আছে, অবশ্য ফরিদের মুখে শোকতাপের কোনো চিহ্ন নেই। নিতু মরে যাক না বেঁচে থাকুক, তাতে তাঁর কিচ্ছু যায় আসে না টাইপ ভাব। এর ভেতর একজন নার্স এসে বলে, রিয়াজ কে?
রিয়াজ শুনেই নিতুর বাবার মেজাজ গরম হয়, ‘রিয়াজ দিয়ে কী হবে?’
নার্স আবার বলে, ‘রিয়াজ কে?’
—রিয়াজ হলো অ্যাডমিন। ফেসবুক গ্রুপের অ্যাডমিন।
—যে মিনই হোক তাকে দরকার। অনেক চেষ্টার পর মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে। সে রিয়াজ রিয়াজ করে কাঁদছে। এখন কান্নাকাটি করলে তাকে বাঁচানোই মুশকিল।
রিয়াজ ও তাঁর পরিবারের লোকদের খবর দেওয়া হলো। খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে আসে রিয়াজ ও তাঁর বাবা-মা। ক্লিনিকেই ঠিক হয় বিয়ের দিন–তারিখ।

বাড়ি ফেরার পর থেকে নিতুর খুশির সীমা নেই। অবশ্য তাঁর ভাই ফরিদের মেজাজ খারাপ। প্রতিদিন বাবার হম্বিতম্বি সহ্য করতে হচ্ছে। বিয়ের বিরাট আয়োজন। ঘানি টানতে হচ্ছে ফরিদের। বৃষ্টি উপেক্ষা করে এদিক–ওদিক ছুটতে হচ্ছে। শরৎ, হেমন্ত না বর্ষা বোঝা যাচ্ছে না। দুদিন পরপর বৃষ্টি। বৃষ্টির ধরনও বর্ষাকালের মতো। বৃষ্টি হলে গরম কমছে, থামলে হু হু করে বাড়ছে। রাস্তাঘাটের অবস্থা জগাখিচুড়ি। আজ মিতুর বিয়ে। কয়েক দিন হলো নিতু সারাক্ষণ গুনগুন করে। যদিও তার গানের গলা খুব একটা ভালো নয়। চিৎকার করে গাইলে শিয়ালের উৎপাত বেড়ে যেতে পারে। ফরিদ কড়া মেজাজে ধমকায়, ‘তুই আর কখনো বিড়বিড় করবি না।’
—কেন?
—অসহ্য লাগে। তোর গান শুনে গরম বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিয়াল, বিড়াল হাজির হয়ে যেতে পারে।
নিতু মুখে হাসি নিয়ে সুর করে বলে, আজ আমার বিয়ে। আহা এ সময়ে বৃষ্টি, বৃষ্টি রে তোর নাম কী?

লেখকের ঠিকানা: দৌলতপুর, খুলনা