নান্দনিক কলকাতা এবং আমি

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

‘কলকাতা তুমিও হেঁটে দেখো, কলকাতা তুমিও ভেবে দেখো, যাবে কিনা যাবে আমার সাথে।’ পরিচিত এই গানের কথা ধারণ করে হেঁটে বেড়িয়েছি এ শহরে। নান্দনিক কলকাতা শহর ভ্রমণ মানেই এক অদ্ভুত নস্টালজিয়া। এই শহরজুড়ে রয়েছে এক অন্য রকম ভালো লাগা।

ঐতিহ্যের কলকাতা
প্রায় চার শ বছরের পুরোনো শহরে কী নেই! শিল্প, সাহিত্য, ঐতিহ্য-ইতিহাস কিংবা বহুগুণে গুণান্বিত মানুষের পদচারণ। কত রাজা, জমিদারের শাসনকাল, রাজদরবারের গল্প, ব্রিটিশ শাসনামলের ইতিহাস, স্থাপত্যকলাসহ বৈচিত্র্য এবং যুগে যুগে মানুষের জ্ঞান-তীর্থ লাভের কেন্দ্র। এ শহর রবীন্দ্রনাথের, এ শহর সত্যজিৎ রায়ের, এ শহর হাজারো গল্প-উপন্যাস-কবিতার। এ শহরের গুরুত্ব প্রথমে অনুধাবন করতে পেরেছিল ব্রিটিশরা। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি মূলত এলাকাটি তখন ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা থেকেই নজরবন্দি করে। সেই থেকে গড়ে উঠে কলকাতা। ক্রমেই প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে।

প্রথমবার কলকাতায়
দুই বাংলার জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো মীরাক্কেল সিজন দশে বাংলাদেশের হয়ে অংশগ্রহণ করার সুবাদেই আমার প্রথম কলকাতা গমন। তখন পৃথিবীতে মহামারির ভয়াবহতা আসেনি। ডাক পেয়েই আমি প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। পাসপোর্ট আগে থেকেই করা ছিল। ভিসা পেয়ে গেলাম ভারতীয় হাইকমিশনের সহযোগিতায়।

মীরাক্কেলের ফোন পাওয়াটা আমার জন্য ছিল অন্য রকম অনুভূতির। তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে চা খাচ্ছি। হুট করে ফোন আসে জি বাংলার অফিস থেকে। তারা জানায়, আমাকে আর্জেন্ট কলকাতা যেতে হবে গ্রমিং এবং শুটিংয়ের জন্য।

খুবই তাড়াহুড়া শুরু হয়ে গেল। দু-এক দিনের মধ্যেই ব্যাগ-লাগেজ গুছিয়ে সবকিছুর প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। ২০২০ সালের মার্চে প্রথমবার কলকাতায় যাওয়া বেনাপোল বর্ডার দিয়ে। যেখান থেকে ২৪ পরগনা জেলা দিয়ে সোজা কলকাতার নিউটাউনে। কলকাতায় গিয়ে ভেবেছিলাম, গ্রমিং এবং শুটিংয়ের ফাঁকে পুরো কলকাতা ঘুরব। কিন্তু ১৫ দিন পরেই ভারতসহ বাংলাদেশেও হানা দেয় করোনাভাইরাস। সেবার দ্রততার সঙ্গেই ফ্লাইট ধরে বাংলাদেশে ফেরা।

হুট করে দেশে চলে আসতে হয়েছিল বলে ভীষণ মন খারাপ ছিল তখন। একে তো কলকাতা ভ্রমণ হলো না। তার ওপরে করোনার হানা দেশেও। প্রকৃতির ওপর হাত নেই। বাধ্য হয়েই অপেক্ষায় থাকা। অপেক্ষায় ছিলাম সবকিছুর জন্য। কয়েক মাস পর দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর খুলে দেওয়া হলো বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার যোগাযোগব্যবস্থা।

কলকাতার জনপ্রিয় স্থানগুলো মনের আনন্দে দর্শন করেছি
ছবি: সংগৃহীত

ফের কলকাতা যাত্রা
এবার নতুন করে বিশেষ ভিসা নিয়ে যেতে হয়েছে। ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দুপুরের ফ্লাইট। সঙ্গে রয়েছে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট। ইমিগ্রেশন শেষ করে চড়ে বসলাম স্পাইস জেট বিমানে। মাত্র ৪৫ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।

কলকাতার এ বিমানবন্দর সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ক্যালকাটা এরোড্রোম হিসাবে বর্তমান নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৫ সালের পূর্বে এটি দমদম বিমানবন্দর নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এ বিমানবন্দরে ছয়টির বেশি বিমান হাব পরিচালিত হয় এবং দুটি সমান্তরাল রানওয়ে রয়েছে।

বিমানবন্দর ঘুরে ঘুরে দেখেছি। আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের ওপরের সিলিংয়ের নকশা। ভারতের সব আঞ্চলিক, দাপ্তরিক ও উপভাষার বিভিন্ন অক্ষরের নান্দনিক ডিজাইন করা ও কারুকার্য সম্পূর্ণ আধুনিক সিলিং। ভেতর– বাইরে সব ধরনের আধুনিকতার ছোঁয়া। হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে দেখছিলাম ভারতের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ও নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকচিত্র।

বিমানবন্দর থেকেই পূর্বের কেনা ইন্ডিয়ান সিম থেকে ফোন করলাম জি বাংলার অফিসে। আমাদের জন্য আগে থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করা ছিল বিমানবন্দরের বাইরে। বের হয়েই গাড়ি পেয়ে গেলাম। পথে যেতে যেতে দেখলাম। আধুনিক কলকাতার সড়ক, বিশ্ববাংলা চত্বরসহ পরিচিত অনেক জায়গা। মাত্র এক ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছে গেলাম গ্রমিং হাউসে অর্থাৎ কলকাতার রাজারহাটের গোপাল ব্যাঙ্কুয়েট হাউসে।

কলকাতায় শুটিংয়ের পর বেশ কিছুদিন লম্বা ছুটি পাওয়া যেত। আমি এই সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে ঘুরেছি শহরে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হাউস, কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত সব বইয়ের দোকান, কফি হাউস, হাওড়া ব্রিজ, হুগলি সেতু, নিউ মার্কেট, এসপ্লানেড পর্যন্ত মেট্রোরেল জার্নি, কলকাতার ইকোপার্ক, বিশ্ববাংলা চত্বর, পার্ক সার্কাস, পার্ক স্ট্রিট, আরসালান রেস্তোরাঁ, ভারতীয় সংগ্রহশালা, রাজারহাট, পুলিশ ফাঁড়ি লাল বাজার, বিখ্যাত বড় বাজারসহ সুপরিচিত জনপ্রিয় স্থানগুলো মনের আনন্দে দর্শন করেছি।

মান্না দের স্মৃতিবিজড়িত সেই ঐতিহাসিক কফি হাউস
ছবি: সংগৃহীত

কলেজ স্ট্রিট এবং কফি হাউস
কলেজ স্ট্রিটের কথা কি ভোলা যায়? আমিও ভুলিনি। একদিন বেরিয়ে পড়লাম। ফেব্রুয়ারির হালকা শীতে, জনপ্রিয় হলুদ ট্যাক্সিতে যাত্রা শুরু। বলা হয়, পৃথিবীর এমন কোনো বই নেই, যেটি কলেজ স্ট্রিটে পাওয়া যায় না। নতুন-পুরোনো সব রকম বইয়ের সারি সারি দোকান, রাস্তার পাশে এবং রাস্তার পাশের সরু গলির ভেতর। ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বাংলা ভাষা ছাড়াও পৃথিবীর নানা ভাষার বিখ্যাত লেখকদের বইয়ের গন্ধ শুকলাম। বইয়ের গন্ধের তুলনা কোনো ফুলের সুঘ্রাণের সঙ্গেও তুলনা হয় না।

আমি বিশ্বাস করি, যে পথিক প্রশ্ন করতে জানে, সে পথিক পথ হারায় না। হলোও ঠিক এমনটা। এক অপরিচিত দাদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা, কফি হাউসটা কোথায়? ব্যস দেখিয়ে দিল। মাত্র দুই মিনিটের মধ্যেই খুঁজে পেয়ে গেলাম মান্না দের স্মৃতিবিজড়িত সেই ঐতিহাসিক কফি হাউস।

ওপরে যাওয়ার সেই ঐতিহাসিক সিঁড়িগুলো দিয়ে উঠছি, আর তখনই মনে মনে বাজছিল, ‘কত স্বপ্নের রোদ উঠে, এই কফি হাউসে, কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়! কতজনই এল গেল, কতজনই আসবে! কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়!’

আমিও এসে গেছি কত দিনের বাসনার প্রিয় কফি হাউসে। প্রতিটি টেবিলে টেবিলে হাজারো সম্ভাবনার ইতিহাস। যেখানে সত্যজিৎ রায়সহ কত বিখ্যাত কবি, শিল্পী, লেখক ও গুণী ব্যক্তি আড্ডা দিয়েছেন। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখি চারপাশের টেবিলে নানা বয়সী মানুষের ভীষণ ভিড়। বেয়ারাদের সাদা এবং মিশ্র রঙের পাগড়িসহ নান্দনিক পোশাক। একবার টেবিল আঁকড়ে ধরতে পারলেই, যতক্ষণ ইচ্ছে সময় নিয়ে আড্ডা দেওয়া যায় কফি হাউসে।

বলে রাখা ভালো, কফি ছাড়াও অন্যান্য মুখরোচক টুকটাক খাবারও পাওয়া যায় এখানে। আমি কফি আর কাটলেট অর্ডার করলাম।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভবনের সামনে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভ্রমণ
অনেক দিন ধরেই কলকাতার সুমন দা ইনভাইট করেছেন। দাদার বাসা পার্ক সার্কাসে। সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল মিউজিয়াম খুবই নিকটে। সুমনদার বাসায় নাশতা করার পর ঠিক সকাল ১০টায় হাঁটতে হাঁটতে রওনা দিলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের সামনে যেতেই হঠাৎ দেখলাম একটি সাইনবোর্ড, যেখানে লেখা শেখ মুজিবুর রহমান সড়ক। যা বাংলাদেশ সড়ক নামেও স্থানীয়ভাবে সুপরিচিত। দেখেই অন্য রকম অনুভূতি জাগ্রত হলো আমার মনে। দারুণ ভালো লাগা, গর্ব হতে লাগলো। যেন এখানেও এক টুকরো বাংলাদেশের অস্তিত্ব।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের খুব কাছে বাম পাশেই ঐতিহাসিক প্যারেড গ্রাউন্ড। অবশ্যই আমার টার্গেট ছিল ভিক্টোরিয়াল মেমোরিয়াল। টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করতেই মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম চারপাশের বাগান ও লেক। আছে ব্রিটিশদের বৈচিত্র্যময় ভাস্কর্য। কি দারুণ মনোরম পরিবেশ। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভবনে যেতে যেতেই মনে হচ্ছিল ইতিহাসের কোনো অংশে প্রবেশ করেছি।

১৯০১ সালে যখন রানি ভিক্টোরিয়া মারা যান, তারই স্মরণে এবং স্মৃতি রক্ষার্থে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের তত্ত্বাবধানে ১৯০৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছরে এটির নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হয়। এর নকশা করেন ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের স্যার উইলিয়াম এমারসন।

কলকাতা শহর গল্পের চেয়েও বেশি নান্দনিক
ছবি: সংগৃহীত

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল মূলত ইতালির ভাস্কর্য নির্মাণশৈলী দ্বারা অনুপ্রাণিত। এ ছাড়া এখানে মুঘল রীতির গম্বুজ নকশা কাজ করা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন বাগানের নকশা করেছিলেন রেডেডেল আর পুরো নির্মাণকাজ করেন মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি।

যদিও শুনেছি, পূর্বে এটি ব্রিটিশদের বিভিন্ন নিদর্শনের মিউজিয়াম হিসেবে ছিল। কিন্তু আমি যা দেখেছি, তা হলো ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। তা ছাড়া স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারতীয়দের ত্যাগ ও নেতাজির বিভিন্ন অবদানের বিষয়গুলোই বেশি প্রদর্শন করা হয়েছে। তা ছাড়া রয়েছে দেয়ালে বিশাল আকৃতির পেইন্টিং। ইংরেজদের জাহাজের নকশা, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নকশা ও আকৃতি। ব্রিটিশদের ব্যবহৃত অস্ত্র, ঢাল-তলোয়ার, বন্দুক, রাজকীয় সৈনিক ও কর্মকর্তাদের পোশাক ও অলংকার।

ভ্রমণ সব সময়ই সুন্দর ও নানা অভিজ্ঞতায় জড়ানো থাকে। কলকাতা শহর গল্পের চেয়েও বেশি নান্দনিক, বৈচিত্র্যময়। ধারাবাহিকভাবে আমার পরবর্তী লেখায় জানাব কলকাতার জনপ্রিয় রুচিশীল খাবার, মজার ঘটনা এবং বেশ কিছু দর্শনীয় স্থানের ইতিহাস ও ভ্রমণ গল্প।