নাটক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে
প্রথম আলোর একটি স্লোগান ‘যত দিন তোমাদের হাতে থাকবে দেশ, ততদিন পথ হারাবে না বাংলাদেশ’। এ প্রসঙ্গটি আনতে গিয়ে তারা বাংলাদেশের লড়াকু কৃষক, পোশাকশ্রমিক, তরুণ উদ্ভাবক, বিনিয়োগকারী ও তরুণ প্রজন্মকে বুঝিয়েছেন। আমার তখনই মনে হয়েছে, বাংলাদেশের থিয়েটারকর্মীদের নির্দিষ্ট করে তাঁদেরও রাখা উচিত ছিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরে নিজেদের চেষ্টা, শ্রম ও অর্থ দিয়ে সদ্য মুক্তিযুদ্ধফেরত একদল তরুণ থিয়েটারচর্চা শুরু করেন। মহিলা সমিতিকেন্দ্রিক সেই চর্চা আজ বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের নাটক এখন বিশ্বসভায় প্রশংসিত। তারই ফলে বিশ্ব নাট্য সংস্থার পরপর দুবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন আমাদের রামেন্দু মজুমদার। এটা কত বড় সম্মানের বিষয়, তা আমি আইটিআই ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসে গিয়ে বুঝতে পেরেছি।
পৃথিবীতে থিয়েটারচর্চা হয় সরকারি আনুকূল্যে কোম্পানির মাধ্যমে। সব অভিনেতা-অভিনেত্রী সরকারি টাকায় নিয়মিত মাসিক বেতনের মাধ্যমে শুধুই নাটক করেন। আমাদের দেশের নাট্যকর্মীরা বিনা পারিশ্রমিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজের পয়সায় এ চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে বলতে পারি, ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা ’৭২ সাল থেকে বিগত ৪০ বছরে সারা বাংলাদেশে লাখ লাখ তরুণ প্রজন্মকে দেশাত্মবোধ, মানবতাবোধ, সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে। নইলে সম্প্রতি ছাত্ররাজনীতির নামে যে ন্যক্কারজনক দৃশ্য আমরা দেখছি, তা আরও তীব্র হতো। এই কিছুদিন আগে একাত্তরের মানবতাবিরোধী বিচারের রায়ের আগে একশ্রেণীর তরুণ হায়নার দল দেশব্যাপী যে তাণ্ডব চালিয়েছে, তা থেকে উত্তরণের পথ থাকত না। বিগত ৪০ বছরে নাট্যচর্চা যে তরুণ প্রজন্মকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে, তারাই মূলত পথ দেখিয়েছে। আর একুশ শতকের ইতিহাসমনস্ক তরুণেরা করেছে প্রতিরোধ, তা না হলে শাপলা চত্বরে অন্ধকার যুগের সময়ের মতো একদল হিংস্র তরুণেরা যা শুরু করেছিল, তারা বিজয়ী হলে দেশ মধ্যযুগে প্রবেশ করত।
কোনো প্রকার সরকারি আনুকূল্যবিহীন আমরা থিয়েটারকর্মী ও সংগঠকেরা সারা দেশের একশ্রেণীর তরুণ প্রজন্মকে থিয়েটারচর্চায় ব্যস্ত রাখছি। তাদের নষ্ট কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করি। মাদক আড্ডার চেয়ে এসব তরুণ থিয়েটারে সময় দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলতে গেলে বলতেই হবে থিয়েটার আমার চিন্তাচেতনা, সমাজ সচেতনতা ও তারুণ্য ধরে রেখেছে। জীবনের ৪৫ বছর ধরে থিয়েটারে জড়িত আছি। স্কুলজীবনে, ষাটের দশকে পাড়ায় পাড়ায় বার্ষিক নাটক হতো। সেসব নাটকে শিশু চরিত্রে অভিনয় দিয়ে শুরু। পাকিস্তান যুগে বাবার নাট্যজগতে তাঁর সরব পদচারণ ছিল। বাবার অভিনীত নাটক আমি দেখেছি। বাবার হাত ধরে ১৯৬৬ সালে বরিশালের বর্তমান মেডিকেল কলেজ এলাকায় প্রদর্শনীতে প্রথম যাত্রা দেখি সাধক রাম প্রসাদ। সেই যে শুরু আজ অবধি চলছে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় জড়িয়ে গেছি শুরু থেকে।
আমি খুব ভালো ছাত্র ছিলাম না। সাধারণ মানের একাডেমিক রেকর্ড। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। বিত্তবৈভব ছেলেবেলায় দেখিনি। তবে পারিবারিকভাবে উদার ও মুক্ত পরিবেশে মানুষ হয়েছি। ৫০-৬০-এর দশকে মুসলিম পরিবারের মধ্যে বড়দা, মেঝদা, সেজদা, ছোটদা—এমন সম্বোধনে অভ্যস্ত ছিলাম। বরিশাল শহরের আদি বাসিন্দা। মাঝেমধ্যে গর্ব করে বলি, আমি বরিশাইল্যা কুট্টি। এখন মনে হয়, আর কোনো কিছু ভালো করে পারব না বলেই হয়তো থিয়েটার নিয়ে পড়ে আছি। আত্মপ্রত্যয় বলি আর অহেতুক দম্ভের পরিবর্তে নিজেকে নিয়ে গর্ব করার মানসিকতা বলি, তা তৈরি হয়েছে থিয়েটার চর্চায়। সবার পক্ষে এটা সম্ভব। থিয়েটার করতে হলে মানবচরিত্রের বিভিন্ন জটিল বাঁক সম্পর্কে জ্ঞান নিতে হয়। মানবচরিত্র নিয়ে লেখক-কবি-প্রাবন্ধিক কী বলতে চেয়েছেন, তা পড়তে হয়। তাহলেই মানুষের জটিল চরিত্রের ধারাগুলো অভিনয়ের সময় ব্যবহার করা যায়। এ জন্যই একজন মঞ্চ অভিনেতার পড়াশোনা হয়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রে দলপ্রধানকে বড় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। একজন সফল সংগঠক অথবা নির্দেশক তাঁর কর্মী বাহিনীকে বাধ্য করাতে হবে বই পড়তে। এভাবেই একজন মঞ্চ অভিনেতা ব্যক্তিজীবনের জটিল বাঁকগুলোকে উতরাতে পারেন। জীবন প্রতিষ্ঠায় এসব বিষয়ে প্রতিটি পদে কাজে লাগে।
জীবন প্রতিষ্ঠায় ডিসিপ্লিন অথবা নিয়মানুবর্তিতা মূল ভিত্তি। নাট্যচর্চা মানুষকে শৃঙ্খলা শেখায়, ত্যাগ করতে শেখায়। এ ক্ষেত্রে একজন নির্দেশক অথবা সংগঠককে মনে রাখতে হবে, নিজে ত্যাগ না করলে অন্যকে ডিসিপ্লিন করা যায় না। সংগঠনের কর্মীরা যদি বোঝেন, নির্দেশক অথবা সংগঠক নিজে ছাড়ছেন, ত্যাগ করেছেন, তাহলেই তাঁর আদেশ সবাই শোনে এবং মানে। প্রসঙ্গত বলতে পারি, ১৯৯১ সালে ৩১ ডিসেম্বর যখন শব্দাবলীর স্টুডিও থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে প্রতি শুক্রবার দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনী শুরু করি, তখন থেকেই আমি ডিসিপ্লিন মেনে চলছি। আমার আগে স্টুডিওর মধ্যে ছোট-বড় যে-ই থাকুক, অনুমতি না নিয়ে প্রবেশ করিনি। সেই থেকে শুরু, এখন পর্যন্ত কেউ কখনো এ নিয়ম ভাঙেনি। থিয়েটারের এই শিক্ষা ব্যক্তিজীবনে অনেক সহায়ক হয়। বর্তমানে ঢাকায় বিভিন্ন মিডিয়ায় শব্দাবলীর একঝাঁক তরুণ-তরুণী দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। সবাই স্বীকার করেন সংগঠন তাঁদের অনেক শিক্ষা দিয়েছে। থিয়েটার থেকে আসা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মিডিয়া জগতে সব শাখায় ভালো কাজ করতে পারেন। সারা পৃথিবীতে মঞ্চ অভিনেতারা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। আমাদের দেশে চলচ্চিত্র এখনো সুন্দর একটি জায়গা তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু বিজ্ঞাপনচিত্র, টিভি নাটকে এখন অনেক অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে মঞ্চ থেকে আসা মানুষগুলো অনেক দিন টিকে থাকেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে প্রসঙ্গত বলতে পারি, ‘এটিএন তারকা তারকাদের তারকা’ শিরোনামে ২০০৪ সালে বাংলাদেশে একটি প্রতিযোগিতা হয়েছিল। বরিশাল বিভাগীয় বাছাই পর্বে আমি স্থানীয় ব্যবস্থাপনার প্রধান নির্বাহী ছিলাম। বরিশাল থেকে প্রাথমিক বাছাইয়ে ২০ জনের মধ্যে শব্দাবলীর ১২ জন নির্বাচিত হয়েছিল। এটা নিয়ে তখন কথা ছড়িয়েছিলেন অন্য দলের নাট্য সংগঠকেরা। বাকি আটজনের মধ্যে বরগুনা জেলার একজন প্রতিযোগী তার মাসহ শব্দাবলীতে এল। প্রস্তাব দিল ওই ছেলেকে পরবর্তী রাউন্ডে যেতে আমি সহযোগিতা করলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হব। তাকে অভিনয় শেখালে আমাকে পারিশ্রমিক দেবে। মাতা-পুত্রের পরিকল্পনা মিডিয়ায় সুযোগ নেওয়া। ছেলেটার চেহারা ও গাঁয়ের রং সুন্দর ছিল। কিন্তু পরবর্তী রাউন্ডে টিকতে পারেনি। একদিন হঠাত্ দেখি, একটি বেসরকারি মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপনে ভালোভাবেই কাজ করছে। এক-দুই-তিন তারপরে আর নেই। পরে শুনেছি সে এখন এ জগত্ থেকে ছিটকে পড়েছে। আমি মা-পুত্রকে বলেছিলাম, এভাবে টাকা খরচ করে লাভ হবে না। আপনার ছেলেকে বরিশালে কলেজে ভর্তি করান, সেই সঙ্গে নিয়মিত শব্দাবলীতে কাজ করুক, মঞ্চ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নিজেকে পরিপক্ব করুক তারপরে অন্য কিছু। এ ক্ষেত্রে আরও একটি উদাহরণ জাতীয়ভাবে আছে। ১০-১২ বছর আগে একজন নারী মডেল তারকা একটি কোমল পানীয়র বিজ্ঞাপন টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ দেশব্যাপী বিলবোর্ড প্রচারে ব্যাপকভাবে সফল হয়েছিল। সে সময়ে একটি সাক্ষাত্কারে সে বলল, মিডিয়ায় প্রতিষ্ঠা পেতে হলে মঞ্চ অভিজ্ঞতা থাকতেই হবে এমন কথা নেই। সাক্ষাত্কার দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। দু-একজন বিজ্ঞাপন নির্বাহী যাঁরা একাধারে মঞ্চকর্মী, তাঁদের সঙ্গেও আলাপ করেছিলাম। শুরুর এক বছরের মধ্যেই তাকে এ জগত্ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। অথচ জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, চঞ্চল—এরা তো দাপটের সঙ্গেই আছে দীর্ঘদিন। নাট্যকেন্দ্রের মোশাররফ করিমের একটি উদাহরণ এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রযোজ্য। ১৯৯২ অথবা ৯৩ সালের কথা। মোশাররফ বরিশাল আসবে তার জীবনধারণের একটি কাজের প্রাথমিক তদারকি করতে। চিরসবুজ নায়ক মঞ্চাভিনেতা আফজালের বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাজ। অনেক পোঁটলা-প্যাকেট তার সঙ্গে, আমিও বরিশাল আসছি। আমার কেবিনে তার মালামালসহ থাকল। একসঙ্গে খেলাম কিন্তু রাতে ঘুমানোর সময় কোনোক্রমেই তাকে আমার বিছানায় আনতে পারিনি। একটি চাদর বিছিয়ে কাজের প্যাকেট মাথায় দিয়ে রুমের মধ্যে নিচে শুয়ে পড়ল। নাট্যকেন্দ্রের প্রাণপুরুষ তারিক আনাম খানের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক, আমি থিয়েটারচর্চা করি মোশারফের অনেক আগে থেকে। কাজেই সিনিয়রকে কষ্ট দেবে না। এই যে ভদ্রতাবোধ, বিনম্র শ্রদ্ধা, তাকে শিক্ষা দিয়েছে মঞ্চ। তাই তো দীর্ঘদিন ধরে মোশাররফ করিম অভিনেতা হিসেবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, কোনো তরুণ-তরুণী তার জীবনের শুরুতে একাডেমিক পড়াশোনার বাইরের সময়টুকু যদি আন্তরিকভাবে থিয়েটারচর্চায় দেয়, তবে তার ভবিষ্যত্ জীবনচলার পথে এত বড় সহায়ক শিক্ষা আর কোনো কিছুর মাধ্যমে অর্জন সম্ভব নয়। আমার ব্যক্তিজীবনে তা অত্যন্ত চমত্কারভাবে অনুভব করেছি। ১৯৮৬ সালে আমি রুটি-রুজির তাগিদে জাপানপ্রবাসী হয়েছিলাম। না, কোনো আদম ব্যাপারীর মাধ্যমে নয়। বন্ধু ফারুক আদম ব্যাপারীর মাধ্যমে আমার আগে টোকিও গেছে তার কাছ থেকে চিঠির মাধ্যমে সবকিছু জেনে একাই পৌঁছেছি। ব্যাংকক, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ঘুরে একজন পর্যটকের মতোই টোকিও নারিতা বিমানবন্দরে নেমেছিলাম। এই যে সাহস, আত্মপ্রত্যয়, নানা ঘটনার মোকাবিলা করা, তা আমাকে শিক্ষা দিয়েছে থিয়েটারচর্চা। আমি যতটুকু সমৃদ্ধ হয়েছি, এখনো ৩০ বছরের যুবকের মতো কাজ করছি, তা থিয়েটারের কল্যাণে। না হলে বাবার অবসরের সময় তাঁর অফিসে নিয়োগ নিয়ে আমার জীবন শুরু করতে হতো। এত দিনে আমাকেও অবসরে গিয়ে নাতি-নাতনি নিয়ে সামাজিক ধর্মভীরু হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে হতো।
জয় হোক নাট্যচর্চার, জয় হোক মানবতার।