দ্রামিক

অলংকরণ: আরাফাত করিম

আজকেও অফিসে পৌঁছাতে ১০টা ১৬ হয়ে গেল। প্রায় রোজই ট্রাফিকে এমন ফাঁসে যে সেই জট কাটিয়ে অফিস পৌঁছাতে দশটা পনেরো–কুড়ি হয়েই যায়। রজতাভ কোনো রকমে গাড়ি পার্ক করে দৌড়াতে দৌড়াতে লিফটের কাছে আসেন। এসে দেখেন জনা দশেক লোক দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে তার জায়গা সুনিশ্চিত নয় বুঝতে পেরেই সিঁড়ি দিকে এগোন। পাঁচতলায় অফিস। এতটা সিঁড়ি এই বয়সে ভাত খেয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হয়। রজতাভ তবু সিঁড়ি দিয়ে ওঠা ঠিক মনে করলেন, কারণ লিফট ১২তলা গিয়ে খালি হবে, তারপর আবার প্রতি তলায় ভরতে ভরতে নামবে। রজতাভ হাঁপাতে হাঁপাতে অফিসে ঢুকে বায়োমেট্রিকে ফিঙ্গার পুশ করে এসেই চেয়ার টেনে বসেন। তাঁর চেয়ারে বসার অনেক আগেই ফাইল স্তূপ করে টেবিলে বসানো আছে। সবই মি. চৌধুরীর কারসাজি, সেটা ভালোই বুঝতে পারেন। রজতাভ ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করে গলা ঠান্ডা করে স্তূপের তলা থেকে একটা ফাইল টেনে বের করে পাতা ওল্টাতে শুরু করেন। মিনিট দশেক যেতে না যেতেই ইন্টারকমে মি. চৌধুরীর গলা, ‘একটু আগে এলে কি ক্ষতি হয়? কার অ্যালাউন্স তো টাইমমতোই পেয়ে যাও, তবুও যাই হোক, পাঁচটা মেল ফরোয়ার্ড করেছি তোমায়। ভালো করে দেখে রিপলাই দিয়ে দিয়ো, আর ইউনিটগুলো ভেরিফাই করতে ভুলো না।’
রজতাভ হুঁ–টুকু বলে কম্পিউটার অন করেন। কাজের মধ্যে ডুবে যেতে বসেছেন, এমন সময় মোবাইলটা বেজে ওঠে। আড় চোখে দেখে নিয়ে আবার মনিটরে মনোনিবেশ করেন। আবারও ফোন বেজে ওঠে। নীলিমার ফোন। ‘...এই এক বিরক্তিকর ফোন, রোজ অফিস পৌঁছে প্রেশারের ওষুধ খেয়েছি কি না, জানানোর জন্য ওকে মিস কল দিতে হবে।’
নীলিমার ফোন কেটে দিয়ে রজতাভ অফিসের ডেস্কের ড্রয়ারে রাখা ‘টেলমি সার্টনের’ পাতা বের করে একটি ট্যাবলেট জলসহ মুখে দিয়ে আবারও মনিটরে চোখ রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে আবার মোবাইল বেজে ওঠে। ‘এই মহিলা তো আমাকে পাগল করে তুলবে দেখছি, অফিসে ঢুকতে না ঢুকতে এক শ বার ফোন।’ অত্যন্ত বিরক্তিসহকারে ফোন ধরে রজতাভ, ‘কী হলো, কাজ করতে দেবে না? এর থেকে বাড়িতে বসেই থাকতাম আমি, বসে বসে সারা দিন তোমার কথা শুনতাম।’
‘শুনছো, বাবিনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে!’ হু হু করে কেঁদে ফেলে নীলিমা।
‘কেন! বাবিন তো টিউশনিতে গেছিল?’
‘হ্যাঁ...অ্যা (কেঁদেই চলেছে), প্লিজ তুমি বাড়ি ফিরে এসো, থানায় যেতে হবে এক্ষুনি, বাবিনকে টিউশন ক্লাস থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। কুন্তল এসে আমাকে খবর দিল। বৈদেহী রেপ কেসে তমাল–সূর্যের সাথে বাবিনকেও পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। শুনছো, তোমায় বলেছিলাম না তিন দিন আগে একটি মেয়েকে সন্ধ্যায় পার্কের ফুটপাতে রক্তাক্ত অচৈতন্য অবস্থায় কারা যেন ফেলে গিয়েছিল। পথচারীরা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেই মেয়েটাই বৈদেহী, বাবিনের সাথে স্বপন স্যারের কাছে অঙ্ক শেখে। মেয়েটার অবস্থা খারাপ। চেতনা ফেরেনি ঠিকমতো। সে ওই অবস্থায় তমাল, সূর্য ও দ্রামিকের নাম নেয় গো। আবার জ্ঞান হারায় বিশেষ কিছু বলতে পারেনি। দ্রামিক এই কাজ কখনই করতে পারে না গো।’
‘তুমি শান্ত হও, আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছি...।’ বলেই রজতাভ ফোন রেখে দিয়েই মি. চৌধুরীর কেবিনের দিকে দৌড়ান। ছুটি কিছুতেই পাওয়া যাবে না দেখে রজতাভ এক দিনের ছুটির জন্য সাত দিনের পে অফ করিয়ে রেজিস্টারে নোট লিখে বেরিয়ে পড়েন।’

বাড়িতে পৌঁছেই নীলিমাকে নিয়ে থানায় আসেন রজতাভ। জীবনে কোনো দিন থানার চৌকাঠে পা রাখেননি। আজ এই চোর, ছ্যাঁচড়, গুন্ডা ও পুলিশের সহাবস্থান দেখে বুকটা কেঁপে উঠে রজতাভের। অজানা আতঙ্কে গলা–জিব শুকিয়ে আসছে। রজতাভ টাইয়ের নটটা আলগা করে নেন। ভেতরে ঢুকে হাড় হিম হয়ে যাওয়ার অবস্থা। সাব ইন্সপেক্টরের টেবিলের পাশেই পাঁচ গজ দূরে লকাপে তখন চলছে বলপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রচেষ্টা। নীলিমা সেটা দেখতে পেয়েই ছুটে এসে হাতজোড় করে মিনতি করেন, ‘স্যার, দ্রামিক এই কাজ করতে পারে না, প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন।’
‘ছেড়ে দেবার কথা আপনি বলার কে?’ তীক্ষ্ণ স্বরে ধমকে ওঠেন ইন্সপেক্টর।
রজতাভ সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘আমরা দ্রামিকের মা–বাবা, আমরা নিশ্চিত ও এই কাজ করার ছেলে নয়। প্লিজ, স্যার, আর মারবেন না। মরে যাবে ছেলেটা, ও আমাদের একমাত্র সন্তান। ও মরে গেলে আমরা শেষ হয়ে যাব, স্যার।’
‘ও তাই! আর মেয়েটি যে শেষ হয়ে গেল। সে–ও তো বাবা–মায়ের একটিমাত্র মেয়ে। ওরা আর সমাজে মুখ দেখাতে পারবে, বলুন তো? এখনো কুড়ি পেরোয়নি। এই বয়সে এত নিকৃষ্ট মনোবৃত্তি! অমানুষ একটা, একই সাথে পড়াশোনা করে, কী করে সহপাঠীকে রেপ করল? মেয়েটিকে আঁচড়ে–কামড়ে শেষ করে দিয়েছে প্রায়। মেয়েটিকে গণধর্ষণ করা হয়েছে, বুঝলেন!’ ইন্সপেক্টর এরপরও রজতাভ ও নীলিমার সামনেই দ্রামিককে অশ্লীল সম্ভাষণে কটূক্তি করে গেলেন।
দ্রামিক রুলের বাড়ি খেতে খেতে তারস্বরে চিৎকার করছে, ‘বাবা, আমাকে বাঁচাও। আমি কিছু করিনি। আমি তমাল–সূর্যকে অনেক বারণ করেছিলাম। ওরা আমাকে বাথরুমে লক করে দিয়েছিল। তোমাকে আর মাকে গুম করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল, তাই আমি ভয়ে চুপ ছিলাম। বৈদেহীকে আমি কিছু করিনি, ওকে জিজ্ঞাসা করো, প্লিজ।’
‘দেখুন স্যার, ও নিজে বলছে কিছু করেনি। একবার মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করুন, তারপর না হয় চামড়া তুলে নেবেন। এটা ঠিক হচ্ছে না, স্যার। আইন তো সবার অল্প বিস্তর জানা আছে, স্যার।’
বারবার দ্রামিকের একই স্বীকারোক্তি দেওয়ার কারণে পুলিশ দ্রামিকের শরীর থেকে রুলটা সরিয়ে রাখাটা যুক্তিসংগত বলে মনে করে এবং বৈদেহীর পূর্ণ বয়ান অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে পুনরায় হাসপাতালে যায়।
দুদিন পরে জ্ঞান ফিরতে বৈদেহী বয়ান দিয়েছে, ‘টিউশনি থেকে ফেরার পথে তমালের বাড়িতে নোটস নেওয়ার জন্য যাই। বাড়িতে তমালের মা–বাবা কেউ ছিল না দেখে নোটস নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে যাই, তখনই তমাল ও সূর্য পথ আটকে দাঁড়ায়। দ্রামিক বারণ করেছিল, ওকে বাথরুমে আটকে রাখে ওরা। পরিচিত বন্ধুরা এমনই পাশবিক অত্যাচার করে যে আর কিছু মনে নেই।’

দ্রামিক লকআপ থেকে ছাড়া পায়। শিরদাঁড়ায় ভীষণ চোট পায়, হাতে পায়ে কালসিটে পড়ে গেছে। অসহ্য মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণায় কাতর দ্রামিক নিজেকে গৃহবন্দী করে নিয়েছে। চোখের সামনে মান–সম্মানের নিলাম হতে দেখে বিধ্বস্ত। গ্রুপ স্টাডি করতে গিয়ে একবারের জন্য বুঝতে পারেনি তমাল, সূর্যর অভিসন্ধি।
আজই সকালে নিচের ফ্ল্যাটের তন্ময় নিয়োগী ফ্ল্যাটের সিঁড়িতে দ্রামিকের মাকে দেখতে পেয়ে, ‘শুনলাম নাকি আপনার ছেলে বৈদেহীর রেপ কেসে ধরা পড়েছে! এত অধঃপতন ছেলের! ভালো শিক্ষা মনে হয় ছোটবেলা থেকে পায়নি?’ নীলিমা চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমার ছেলে কিছু করেনি, ওকে থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে।’ চিৎকার শুনে পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস গুপ্তা বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কিছু করেনি তো মেয়েটিকে বাঁচালো না কেন? দেখে মজা নিচ্ছিল, বলুন? চোরের মায়ের বড় গলা, হুঁ...।’
নীলিমা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ঢোকেন। দ্রামিকই দরজা খুলে দেয়। মায়ের চোখের জল দেখে দ্রামিক মাকে কিছু বলতে যায়, তখনই নীলিমা দেবী বললেন, ‘ও কিছু নারে। মিসেস গুপ্তা সুযোগ পেয়েছে আর কি। তুই বাবিন নাশতা খেয়ে স্নান করে নে বাবা।’
এরই কিছুক্ষণ পর দুপুরে দ্রামিকের বড় মাসি সবিতা সেনের ফোন আসে। নীলিমা বাথরুমে ছিলেন বলে দ্রামিক ফোন ধরে। হ্যালো বলার আগেই সবিতা মাসি বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ রে নীলু, দ্রামিকের নামে কি শুনছি রে? শেষে কিনা রেপ কেসে জড়াল! আমার তো পাড়ায় থাকা দায় হয়ে উঠেছে। বাড়িতে সবাই ছিঃ ছিঃ করছে। দ্রামিক এটা কি করল? বাড়ির সুনামের কথা একবারও চিন্তা করল না, ছিঃ ছিঃ।’
উত্তর না দিয়ে ফোন রেখে দ্রামিক নিজের ঘরে বিছানায় এসে শোয়। চোখের দৃষ্টি ঘুরন্ত ফ্যানের দিকে। হাজার প্রশ্নের ঝড় আছড়ে পড়েছে দ্রামিকের, ‘আমি করেছিলাম কি? কেন এত মার খেলাম? আমার জন্য মা–বাবা মুখ দেখাতে পারছে না। বৈদেহী আমার ভালো বন্ধু, ওর সম্মান বাঁচাতে পারলাম না। স্বপন স্যার গতকাল বাজারে বাবাকে দেখতে পেয়ে বলেছেন, উনি আমাকে আর পড়াবেন না। আমার দোষটা কোথায়? আমি তো গ্রুপ স্ট্যাডি করতে গিয়েছিলাম। একবারও তমাল, সূর্যর অভিসন্ধি বুঝতে পারিনি। না, আর না। সবাই নোংরা, বন্ধু, সমাজ, প্রতিবেশী, স্যার—সবাই নোংরা। ওদের নিজেদের মন নোংরা, একদম নোংরা। তাই আমাকেও ওরা নোংরা বানিয়ে দিল। আমার গা ঘিনঘিন করছে। এই সমাজের চোখে আমি আর কোনো দিনও সম্মান ফিরে পাব না। আর দরকার নেই এখানে থাকার। আর থাকব না এখানে...। ’

‘এই বাবিন, দরজা খোল, বেলা দুটো বেজে গেছে, স্নান করে খেয়েনে। কী রে! দরজা খোল?’ সমানে দরজায় ধাক্কা দিয়ে চলেছেন নীলিমা। ‘খোল দরজা...খোল...।’
অভিমানী দ্রামিক কেন দরজা খুলবে? দরজার বাইরে বেরোলেই তো নোংরা, আবার গা ঘিনঘিন করে উঠবে। তার চেয়ে বরং ফ্যানে বিছানার চাদর বেঁধে ঝুলছে, হালকা হালকা দুলতে দুলতে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। আর তার গায়ে–মনে নোংরা লাগবে না...।
ধড়ফড় করে উঠে পড়ে রজতাভ। কী ভয়ংকর স্বপ্নে তলিয়ে গেছিলেন রাতভর। জানুয়ারি মাসের শীতেও কুলকুল করে ঘামছেন। লেপ অনেক আগেই লাথি মেরে সরিয়ে দিয়েছেন। বিছানায় ডান পাশে কুঁকড়ে শুয়ে আছে নীলিমা, গায়ে লেপের চার ভাগের এক ভাগ ঢাকা দেওয়া আছে বাকিটা বিছানা থেকে মাটিতে ঝুলছে। রজতাভ তখনো জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে হাঁপাচ্ছেন। গলা–বুক শুকিয়ে উঠেছে। এই ভয়ংকর অনুভূতি যে দুঃস্বপ্ন, সেটা ধাতস্থ হতে সময় লাগে। কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর লেপটা টেনে নিয়ে নীলিমাকে ঢেকে দেন। ধীরগতিতে উঠে দরজা খুলে দ্রামিকের ঘরে যান। তাঁর আদরের বাবিন কানে হেডফোন লাগিয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সামনের এপ্রিলে ১২ ক্লাসের বোর্ড দেবে। অনেক রাত পর্যন্ত পড়ে। এরপর গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। রজতাভের চোখে জল এসে যায়। বাবিনের ঘন চুলে হাত বুলিয়ে বিড়বিড় করে নিজ মনে বলে ওঠেন, ‘বাবিন, তোর সম্বন্ধে আমরা খারাপ কিছু ভাবতে পারি না। তুইও বাবিন সর্বদাই শুভ চিন্তাই করিস। আমরা প্রাণ দিয়ে তোকে ভরসা দিয়ে যাব সারা জীবন, তুই শুধু সুস্থ থাকিস আমাদের জন্য ও তোর নিজের জন্য।’

সল্টলেক সিটি, কলকাতা